রেল লাইনে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এর মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগ একের পর এক ট্রেন দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত। সাম্প্রতিক রেকর্ড বলছে, ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসেই শুধু এই বিভাগে অন্তত ১৮টি বড় লাইনচ্যুতির ঘটনা ঘটেছে।
নিয়মানুযায়ি, রেললাইনে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা নিয়মিত সরেজমিনে দেখার দায়িত্ব বিভাগীয় কর্মকর্তাদের। সরেজমিনে গিয়ে কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে সেটার সমাধান করলে দুর্ঘটনা অনেকাংশ কমে। কিন্তু কর্মকর্তারা সরেজমিনে না গিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনা বাড়ছে।
অভিযোগ উঠেছে, রেলওয়ের ঢাকা বিভাগের ডিআরএম মহিউদ্দিন আরিফ রেল লাইন সরেজমিনে যান না। এটা নিয়ে স্বয়ং উপদেষ্টাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যদিও অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন মহিউদ্দিন আরিফ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলা, অনিয়ম ও দুর্নীতির এক ধারাবাহিক চিত্র। এভাবে চলতে থাকলে যে কোনো সময় ভয়াবহ ট্র্যাজেডির শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
এদিকে রেললাইনের যখন এমন বেহাল দশা তখন রেলওয়ের ঢাকা ডিভিশনের ডিএন ওয়ান, ডিএন টু, ডিসিও, ডিএসটিই ও ডিইই দফতরের বিরুদ্ধে জমি বরাদ্দ, লিজ, প্রকল্পের কেনা–কাটা, বগি ও যন্ত্রাংশ কেনায় টেন্ডার অনুমোদনের জন্য ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়মিত ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ঘুষ সংক্রান্ত আলোচনার একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। অথচ ট্রেন লাইনচ্যুতির ধারাবাহিক ঘটনায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগে বারবারের লাইনচ্যুতি প্রমাণ করছে রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় ভয়াবহ গাফিলতি রয়েছে। এতে যাত্রীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কোনো একদিন এই অবহেলা রূপ নিতে পারে ভয়াবহ ট্র্যাজেডিতে।
রেল বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরের সালনা ও শ্রীপুর এলাকা যেন দুর্ঘটনার কালো দাগ। চিলাহাটি এক্সপ্রেস (৮০৬), সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস (৭৭৬) ও মহুয়া কমিউটারসহ একাধিক ট্রেন এখানে লাইনচ্যুত হয়েছে।
ঢাকার বিমানবন্দর রেলস্টেশনও সমান ঝুঁকিপূর্ণ—মাত্র দুই মাসে সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস, যমুনা এক্সপ্রেস (৭৪৬) ও হাওর এক্সপ্রেস তিনটি পৃথক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, কক্সবাজার এক্সপ্রেস (৮১৪) এবং মহানগর এক্সপ্রেস (৭২২)–এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে রাজধানী ও বন্দরনগরীর যোগাযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। এমনকি কমলাপুর স্টেশনও রেহাই পায়নি। এখানে যাত্রীবাহী ও কন্টেইনারবাহী ট্রেন দুবার লাইনচ্যুত হয়েছে।
অলৌকিকভাবে এখনও বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটেনি। তবে প্রতিটি দুর্ঘটনায় যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। নিয়মিত যাতায়াতকারীদের মতে, এখন ট্রেনে উঠলেই ভয় লাগে, কখন কী হবে বলা যায় না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এই অবহেলার ধারা অব্যাহত থাকলে হাজারো যাত্রীর জীবন ঝুঁকিতে পড়বে এবং একটি বড় ট্র্যাজেডি কেবল সময়ের অপেক্ষা।
এমন পরিস্থিতিতে হতাশার কথা জানিয়ে একজন প্রকৌশলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘সালনা, শ্রীপুর, টঙ্গী ও বিমানবন্দর স্টেশনের কাছে রেললাইনের অবস্থা ভয়াবহ। জয়েন্ট আলগা, স্লিপার নষ্ট, ব্যালাস্ট অপ্রতুল। আমরা রিপোর্ট দাখিল করি, কিন্তু ডিআরএম অফিসে পড়ে ধুলো জমে। বাজেট অন্যত্র চলে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের ভেতরের অনেকেই অভিযোগ করছেন বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিরাপত্তার চেয়ে অবৈধ আয়ের প্রতি বেশি ঝুঁকছেন। ডিআরএম মহিউদ্দিন আরিফ ও তার প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে গুরুতর গাফিলতির অভিযোগ থাকলেও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
মহিউদ্দিন আরিফ বলেন, আমাদের প্রকৌশলীরা দিনরাত কাজ করছেন। পুরোনো অবকাঠামো, ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি ও আবহাওয়া—এগুলোই মূল কারণ।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে রেল মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে জানা গেছে। রেল মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে এ নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
রেল সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ ও অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, রেলের প্রতি যাত্রীদের আস্থা আরো বাড়তে হবে।