নির্বাচন ইস্যুতে সংকট কাটছেনা রাজনীতিতে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিলেও তার আয়োজন ও সিস্টেম নিয়ে আবারো রাজপথে নামছে রাজনৈতিক দলগুলো। এরই মধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি দল কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে। রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে আলোচনা চলছিল, সেটি আবারো আটকে যাচ্ছে।
জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে আবার কর্মসূচি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ছয়টি দল। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে গণসংযোগ, গণমিছিল ও জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া। একই দাবিতে প্রথম দফায় রাজধানীসহ সারা দেশে দলগুলো সেপ্টেম্বরের ১৮, ১৯ ও ২৬ তারিখে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। কর্মসূচি ঘোষণাকারী দলগুলো হলো জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। এ ছাড়া প্রায় একই দাবিতে আন্দোলনে থাকা খেলাফত মজলিস ৪ অক্টোবর কর্মসূচি ঘোষণা করবে বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন করা, আগামী জাতীয় নির্বাচনে উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতি চালু করা, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) নিশ্চিত করা, ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
কর্মসূচির বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। সরকার প্রধান এতে সাড়া দিয়ে জামায়াতকে বৈঠকে ডাকলে সেখানে দলের যুক্তি উপস্থাপন করা হবে। আলোচনার টেবিলে এ বিষয়ের একটা নিষ্পত্তি হতে পারে, সে সুযোগও রয়েছে।
কর্মসূচি ঘোষণা করে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের ইস্যুতে তাদের দল সরকারকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছে। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রের স্থায়ী বিলোপের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের ধীরগতি, আটক ব্যক্তিদের ৭৩ শতাংশ জামিনে মুক্তি পেয়েছে আর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সূত্র মতে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে রাজনীতিতে উত্তাপ তত বাড়ছে। পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে অনৈক্যও দৃশ্যমান হচ্ছে। পিআর পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হলে ‘গণভোট’ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম। তিনি বলেন, বিএনপির একজন নেতা বলেছেন- ৯০ শতাংশ ভোট তাদের, যদি তাই হয় তাহলে তো তারা আসন পাবে ২৭০ এর ওপরে। তারা তো এককভাবে সরকার গঠন করতে পারছে, সমস্যা কোথায়? সংস্কার ও বিচার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারা। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, সংস্কার ও বিচার না করে আপনি কীভাবে নির্বাচন দেন?
বিশ্লেষকদের মতে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখার কৌশল হিসাবে দলগুলো কর্মসূচি দিয়ে থাকতে পারে। তারা বলছেন, পরিবর্তিত অবস্থায় ঐক্য ধরে রাখতে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোকে আগে আলোচনার মাধ্যমে খুঁজতে হবে সমাধানের পথ। একে অপরকে ছাড় না দিলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এজন্য সব পক্ষকে সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। অন্যথায় বিভক্তি-বিভাজনের এই সুযোগ নেবে পরাজিত শক্তি। জামায়াতসহ কর্মসূচিতে যাওয়া দলগুলো বলছে, এর মাধ্যমে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হতে পারে সেটা তারা মনে করেন না। তাদের মতে, জনমত মজবুত করতে এই কর্মসূচি।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, দাবিগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলো একে অপরকে ছাড় দিতে হবে। অন্যথায় দেশের জন্য সমূহ সংকট তৈরি করবে। আর সেই সংকট সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সবকিছু চিন্তা-ভাবনা করেই সব করা উচিত।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। যারা কর্মসূচি দিয়েছেন তারাও ওই আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই এ বিষয়ে রাজপথে আন্দোলনের আহ্বান জানানো অযৌক্তিক। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার প্রতি কোনো সম্মান দেখাচ্ছে না কর্মসূচি দেওয়া দলগুলো। যারা স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চায় তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে জনগণ। তবে তাদের রাজনৈতিক কৌশল হিসাবে গণতান্ত্রিক অধিকার আছে, তারা করতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম গণমাধ্যমকে বলেছেন, সমমনা দলগুলো একই দাবিতে কর্মসূচি দিয়েছে, এটাকে আমরা যুগপৎ বলব না। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা চলাকালীন এ ধরনের কর্মসূচি স্ববিরোধী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা স্ববিরোধী মনে করি না। আমরা মনে করি জনমতকে মজবুত করতে এই কর্মসূচি। বরং ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটা আরও সহায়ক হবে। এই দাবিটা জনগণের সে কথা আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে বারবার বলেছি। এই দাবিটা যে জনগণের সেটা প্রমাণ করার জন্যই এ কর্মসূচি।
জানা গেছে, জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি দলের অভিন্ন দাবিতে ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন। সম্প্রতি সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির সভা হয়েছে। সেখানে যুগপৎ কর্মসূচির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এতে উঠে আসে এই কর্মসূচি ঘিরে দেশে একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য দলগুলোর যে আন্দোলন, দৃশ্যত সেটা সরকারের উদ্দেশ্যে হলেও এর মূল বিরোধ কিংবা দ্বন্দ্ব মূলত বিএনপির সঙ্গে। কারণ জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন, পিআর পদ্ধতিতে ভোট, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিচার, জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার মতো বিষয়গুলোতে ভিন্নমত আছে বিএনপির। দলটি মনে করে, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হচ্ছে না সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠে জনগণের কাছে যেতে হবে। আর সংস্কারের যেসব বিষয় বাকি থাকবে সেগুলো পরবর্তী সংসদে উঠবে।এছাড়া বিএনপি পিআর পদ্ধতি বা এর জন্য গণভোট কোনোটাতেই রাজি নয়। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়েও কোনো পক্ষ নিতে চায় না দলটি। তারা মনে করে, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হবে কি-না সেটা আইন-আদালতের বিষয়। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়েই বিভিন্ন ইসলামী দল একই সুরে কথা বলেছে বিভিন্ন ফোরামে। শেষপর্যন্ত রাজপথের কর্মসূচিও পালন করেছে। আর এই বিষয়গুলো ঘটছে এমন এক সময়ে যখন সরকার ঘোষিত নির্বাচনের বাকি আছে পাঁচ মাসেরও কম। নির্বাচন হতে হলে নির্বাচন কমিশনকে তিন মাস পরই তফসিল ঘোষণার দিকে যেতে হবে। কিন্তু সেই নির্বাচনে রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না বলেই মনে হচ্ছে। তবে আন্দোলনকারী দলগুলা বলছে, বিএনপিকে টার্গেট করে কোনো কর্মসূচি তারা পালন করছেন না। দলগুলো দেশের স্বার্থ নিয়েই নিজেদের মতো করে কর্মসূচি পালন করছে। তারা জনগণের পক্ষে আন্দোলন করছেন। তারা সংস্কারের আইনি ভিত্তি চান, এই সরকারের আমলে বাস্তবায়ন চান, তার ভিত্তিতে নির্বাচন চান। এই দাবিগুলোতেই তারা এক হয়েছেন। এছাড়া পিআরসহ আরও বিষয় আছে। সামনে আরও অনেক দল এখানে আসবে। আন্দোলনরত দলগুলো বলছে, সরকার একটি বিশেষ দলের দিকে ঝুঁকে আছে। ফলে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সমাধান আসছে না। এর জন্যই আন্দোলনের দিকে যেতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে টেবিলে সমাধান না পেয়েই তারা রাজপথে এসেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনদাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা হলে তাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হবে। আর এতে নির্বাচনও অনিশ্চয়তায় পড়ে যেতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবর্তিত অবস্থায় ঐক্য ধরে রাখতে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোকে দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে খুঁজতে হবে সমাধানের পথ। বিশেষ দাবিগুলো দেশের বড়দলগুলোকে মেনে নিয়ে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। একে অন্যকে ছাড় না দিলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এদিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত দেশের শীর্ষনেতারা নির্বাচনি সংস্কার ও পরিবেশ তৈরির দাবি জানিয়েছে স্পষ্টভাবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা উপলব্ধি করছিলাম যে আওয়ামী লীগ যে অবস্থায় দেশকে নিয়ে গিয়েছিল সে অবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া, একদিকে রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তন, অন্যদিকে রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া এই দেশকে আবার পরিবর্তন করা কষ্ট হবে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেছেন, নির্বাচনের আগে জুলাই চার্টার বাস্তবায়ন এবং দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদে পিআর পদ্ধতি চালু করাই এখন সময়ের দাবি। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে করার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাধান করা দরকার। এনসিপি নেতা আখতার হোসেন বলেছেন, কেবল নির্বাচন নয়, তার আগে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের আগে বাস্তব সংস্কার ছাড়া জনগণের আস্থা ফিরে আসবে না। ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে, সেটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। কিন্তু তার আগে সংস্কার কাজগুলো সমাপ্ত করা হলে আরও গোছানোভাবে নির্বাচনের দিকে যাওয়া সম্ভব হবে।