আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থা (আইএমও)-এর ৩৪তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বৈশ্বিক নৌপরিবহন সেক্টরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদান ও সাম্প্রতিক অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেছেন নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।

সোমবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত এ অধিবেশনে বিশ্বের ১৭৬টি সদস্য দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

অধিবেশনের প্রধান এজেন্ডা আগামী দুই বছরের জন্য ৪০ সদস্যের কাউন্সিল নির্বাচন। বাংলাদেশ সেখানে ‘সি’ ক্যাটাগরিতে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

২০২৬-২৭ মেয়াদের জন্য আইএমও কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থিতার কথা উল্লেখ করে ১৭৫টি সদস্য দেশের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান নৌপরিবহন উপদেষ্টা।

তিনি শিপ রিসাইক্লিং, শিপ বিল্ডিং ও নৌবাণিজ্যের বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশের ধারাবাহিক সাফল্য এবং বিশ্বমানের নৌ প্রশিক্ষণের স্বীকৃতিও তুলে ধরেন।

উপদেষ্টা আরও জানান, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দ্বীপ রাষ্ট্রসহ স্বল্পোন্নত দেশের নাবিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও সহযোগিতার আওতায় প্রতিবছর ১০টি বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে।

উদ্বোধনী অধিবেশনে ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বাংলাদেশ সমুদ্রনির্ভর জাতি, আমাদের পরিচয় ও ভবিষ্যৎ গভীরভাবে সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত। গত এক দশকে বাংলাদেশ উপকূলীয় অর্থনীতি থেকে উদীয়মান মেরিটাইম জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে আধুনিকায়ন, উদ্ভাবন ও টেকসই উন্নয়ন পথনির্দেশ করছে।

বাংলাদেশের প্রধান তিন সমুদ্রবন্দর—চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রার দ্রুত ডিজিটালাইজেশন ও অবকাঠামো উন্নয়নের চিত্রও তুলে ধরেন উপদেষ্টা।

বিশেষভাবে তিনি নির্মাণাধীন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা উল্লেখ করে জানান, এটি দক্ষিণ এশিয়াকে বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করবে।

তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের ২১ হাজারেও বেশি নাবিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৌবহরে দক্ষতা, শৃঙ্খলা ও নির্ভরযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে নিজ দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। তারা শুধু কর্মীই নন; সমুদ্রপথে দেশের দূতও।

আইএমও-এর সঙ্গে দীর্ঘ ও গঠনমূলক অংশীদারিত্বের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। নৌ উপদেষ্টা জানান, বাংলাদেশ আইএমও-র বিভিন্ন কমিটিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে ন্যায্য, স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খল বৈশ্বিক সামুদ্রিক বিধিমালা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দর্শন তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, তাঁর ‘থ্রি জিরো’ মতবাদ আমাদের নৌখাতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে নির্দেশনা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং ব্লু ইকোনমি রোডম্যাপকে তিনি বাংলাদেশের সামুদ্রিক অগ্রযাত্রার শক্ত ভিত্তি হিসেবেও উল্লেখ করেন।

এম সাখাওয়াত আরও বলেন, বাংলাদেশ আইএমও কনভেশন-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করছে এবং বন্দর অবকাঠামোর আধুনিকায়ন করছে। পাশপাশি সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ সক্ষমতা এবং মারপোল-কমপ্লেইন পোর্ট রিসিপিশন ফ্যাসিলিটি সম্প্রসারণ করছে।

আইএমও কাউন্সিলে পুনর্নির্বাচিত হলে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল সামুদ্রিক দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তি ও অর্থায়নে ন্যায্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরণ, নাবিক ও মেরিটাইম সেক্টরে পেশাগত প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি, জলবায়ু-সহনশীলতা ও লো-কার্বন শিপিংকে সমর্থন করবে। একই সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক আইএমও গঠনেও নেতৃত্ব দেবে।

অধিবেশন চলাকালে নৌপরিবহন উপদেষ্টা পাকিস্তানের মেরিটাইম বিষয়ক মন্ত্রী এবং বেলিজের জনসেবা, জ্বালানি ও লজিস্টিকস মন্ত্রীর সঙ্গেও আলাদা বৈঠকে করেন।

পাকিস্তানের সঙ্গে বৈঠকে চট্টগ্রাম ও করাচি বন্দরের মধ্যে নৌবাণিজ্য সম্প্রসারণ, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ও পাকিস্তান ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশনের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়।

উপদেষ্টা পাকিস্তানের মেরিটাইম বিষয়ক মন্ত্রী মোহাম্মদ জুনায়েদ আনোয়ারকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। জুনায়েদ আনোয়ারও তাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান।

বেলিজের মন্ত্রী মিশেল চেবাটের সঙ্গে বৈঠকে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ, নৌবাণিজ্য এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়।

উপদেষ্টা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলসহ ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের মেরিন ক্যাডেটদের জন্য চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে উন্মুক্ত বৃত্তির সুযোগের কথা তুলে ধরেন। মিশেল চেবাটে এই সুযোগের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতা করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন।

উল্লেখ্য, অধিবেশন জুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, আলোচনা ও নেটওয়ার্কিং সেশনে বাংলাদেশ তার প্রার্থিতা এবং বৈশ্বিক নৌপরিবহনে ইতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরে সফল প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম ও নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোঃ শফিউল বারীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও অধিবেশনে অংশ নেন।