একপ্রকার শুভঙ্করের ফাঁকির মধ্য দিয়ে বর্তমান ফারাক্কা চুক্তির মেয়াদ আগামী বছর শেষ হবে। এখন শুরু হয়েছে পরবর্তী চুক্তির প্রস্তুতি। কিন্তু ভারতের আচরণে এনিয়ে বাংলাদেশ একরকম অনিশ্চয়তায় পড়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে আগামী ২০২৬ সালে। ইতোমধ্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, এরপর বাংলাদেশের সঙ্গে নিজেদের ‘স্বার্থ অনুযায়ী’ নতুন চুক্তির ব্যাপারে ভাবছে দিল্লি। বিশেষ করে গত বছর আগস্টে বাংলাদেশের যে রজনৈতিক পটপরিবর্তন হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ‘অবন্ধুসুলভ’ আচরণ করে চলেছে। সর্বশেষ তারা বাংলাদেশ থেকে কিছু রপ্তানি পণ্য নেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এই আচরণের নজির রেখেছে। সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি বাতিলের পর এবার বাংলাদেশের সঙ্গে বিদ্যমান গঙ্গা চুক্তিতে পরিবর্তন আনার কথা ভাবছে ভারত। গঙ্গার পানি বণ্টনবিষয়ক চুক্তিটির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। ৩০ বছর আগে ১৯৯৬ সালে এই চুক্তি কার্যকর হয়েছিল। এখন নতুন করে চুক্তির বিষয়টি সামনে আসছে। যেখানে নতুন চুক্তির ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার প্রয়োজন। সেখানে ভারত সম্পূর্ণ নতুন একটি চুক্তি নিয়ে ভাবছে যেখানে তাদের ‘বর্তমান উন্নয়নমূলক বিষয়াবলীর’ বিষয়টি থাকবে। ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে, ১৯৯৬ সালের পুরানো চুক্তির কাঠামো বর্তমান সময়ের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি সম্প্রসারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও নদীবন্দর ব্যবস্থাপনার মতো নানা কারণে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের পানির চাহিদা বহুগুণে বেড়েছে। ফলে, আগের চুক্তির আওতায় নির্ধারিত পানি সরবরাহ দেশটির প্রয়োজন পূরণ করতে পারছে না। ভারতের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি বছর মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত ফারাক্কা ব্যারাজ থেকে তারা আরো অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি নিতে চায়। তাদের দাবি, বর্তমান উন্নয়নমূলক কর্মকা-ের জন্য এই বাড়তি পানির প্রাপ্যতা জরুরি।
প্রথম চুক্তির দৃষ্টান্ত
ফারাক্কা ইস্যু নিয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘে গেলে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে ভারত এটি দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে মিমাংসায় এগিয়ে আসলে সেটি জাতিসংঘে আর আলোচনা হয়নি। এর ধারাবাহিকতায় ফারাক্কা নিয়ে প্রথম ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সাক্ষরিত হয় ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৫ নবেম্বর। ফারাক্কার পানি নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের আলোচনার পর একটি সাফল্যজনক এই পানিবণ্টন চুক্তি। এটি এ পর্যন্ত সাক্ষরিত চুক্তির মধ্যে সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত এবং ফলপ্রসূ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। চুক্তি অনুযায়ী বছরের সবচেয়ে কম প্রবাহের সময়কাল এপ্রিলের শেষ ১০ দিন ফারাক্কায় প্রায় ৫৫ হাজার কিউসেক পানির মধ্যে বাংলাদেশ পাবে ৩৪ হাজার ৫ শত কিউসেক পানি। অপরদিকে ভারত পাবে ২০ হাজার ৫ শত কিউসেক পানি। কোনো কারণে যদি ফারাক্কা পয়েন্টে পানির পরিমাণ কমে যায় তাহলে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশের ৮০ ভাগ অর্থাৎ ২৭ হাজার ৬ শত কিউসেক পানি পাবে। এটি ছিল চুক্তির গ্যারান্টি ক্লজ। এই চুক্তিটির মাধ্যমে ভারত গঙ্গা নদীর আন্তর্জাতিক চরিত্রকে স্বীকার করে। ৫ বছর মেয়াদি এই চুক্তিটি জাতিসংঘে অভিনন্দিত হয়েছিল।
চুক্তিবিহীন ৮ বছর
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মে থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত মোট ৮টি শুষ্ক মৌসুম অতিবাহিত হয়েছে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনোপ্রকার চুক্তি না করেই। ভারত এসময়ে একতরফা গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে সুবিধাজনকভাবে নিজের কাজে লাগিয়েছে। এই সময়কালের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। কিন্তু ভারতের অন্যায্য এবং অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব (গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সংযোগ খাল) পেশ করার ফলে বার বার বৈঠক নিষ্ফল হয়েছে। এতে কৌশলে ভারত এগিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ গঙ্গার পানি বণ্টনে ন্যায়সঙ্গত সমাধান চাইলেও ভারতের আন্তরিকতার অভাবে সব ধরনের প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়। বাধ্য হয়ে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৮তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে ফারাক্কা প্রশ্নসহ গঙ্গার পানি ভারত কর্তৃক একতরফাভাবে প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরেন। এ ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার মোট ৩ বার বৈঠক হয়। প্রতিবার নরসীমা রাও প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও কার্যত ফলাফল থেকে গেছে শূন্য। সর্বশেষে জাতিসংঘের ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর আয়োজিত বিশেষ অধিবেশনে পূনরায় ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব এবং ন্যায়সঙ্গত পানি চুক্তির বিষয়ে আলোকপাত করে বেগম খালেদা জিয়া বক্তব্য রাখেন।
অতঃপর ভারতের অকংগ্রেসি সরকার ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর মেয়াদি ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এতে ছিল না কোনো গ্যারান্টি ক্লজ। ফলে ভারত ফারাক্কার পানি ইচ্ছামত বণ্টন করেছে বলে বরাবর অভিযোগ উত্থাপিত হয়ে এসেছে। এখন বর্তমান সম্পর্কের নড়বড়ে অবস্থার সুযোগে বাংলাদেশকে পানি থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নিতে চাচ্ছে ভারত।
বাংলাদেশের করণীয়
এমতাবস্থায় করণীয় সম্পর্কে ভাবতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তৃতীয় পক্ষের দেশ পানি সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে অর্থাৎ শুধুমাত্র ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা করে সমাধানে আসা যাবে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি সুষ্ঠু ব্যবহারের স্বার্থে জাতিসংঘ ও বিশ্ব ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, নেপাল, মায়ানমার ও ভুটানকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ফোরাম বা আঞ্চলিক নদী কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন এ অঞ্চলের নদী অববাহিকাগুলোতে পানির সুষম বণ্টন, পরিবেশ সংরক্ষণসহ নদী-তীরবর্তী জনপদগুলোর আর্থিক ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। বিশেষত, নেপালে জলাধার নির্মাণ করে হিমালয়ের পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা গেলে শুষ্ক মৌসুমে ফারাক্কায় পানি প্রবাহ ১ লাখ ৩০ হাজার কিউসেক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাতে সবাই লাভবান হবে। নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের উচিত হবে দেশের স্বার্থে নেপালের সঙ্গে আলোচনায় বসা। এবিষয়ে নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ লেখক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কার কারণে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এখন অবধি বাংলাদেশের আর্থিক কতো ক্ষতি হয়েছে সেটি বিশেষজ্ঞ কমিটি দ্বারা নিরূপণ করে ভারতের কাছে অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশকেও অভ্যন্তরীণভাবেও প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি স্বল্পতা- বাংলাদেশের জন্য এই দুটি সমস্যা বর্তমানে বেশ প্রকট। এগুলোর সুষ্ঠু সমাধানে দেশের নদ-নদী ও জলাশয়সমূহ পুনঃখননের ব্যাপক একটি মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে।