পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পুড়েছে রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তি। এতে ছাই হয়ে গেছে শত শত ঘর। শীতের রাতে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন হাজারো মানুষ। কী করবেন, কোথায় যাবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না কেউ। সাজানো সংসার হারানোর শোকে আচ্ছন্ন তারা। এরমধ্যেই অনেককে দেখা গেছে ছাই-ভস্ম হাতড়াতে, মূল্যবান কোনো কিছু পাওয়ার আশায়। কাউকে দেখা গেল উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াতে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে প্রায় ১৫০০ বস্তিঘর পুড়ে গেছে। এর মধ্য ৫০০ ঘর পুড়ে ছাই হয়েছে। আংশিক পুড়েছে প্রায় একহাজার ঘর। এ আগুনে বস্তির প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

এখনো আগুন লাগার কারণ চিহ্নিত হয়নি। তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে অগ্নিকান্ড ঘটতে পারে। এদিকে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জানা গেছে, মঙ্গলবার রাতে আগুন লাগার পর শিশু-নারী ও বৃদ্ধদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছেন শত শত বস্তিবাসি। গতকাল বুধবার ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই কড়াইল বস্তিতে আগুনের তা-বের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সারারাত আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণে বাঁচা মানুষগুলো সকালে ফিরে দেখেন-তাদের ঘরবাড়ি, সঞ্চয়, সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন অনেক পরিবার খোলা আকাশের নিচে আশ্রয়হীন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। নিজেদের ঘরের ধ্বংসস্তূপে ফিরে অনেকে চেষ্টা করছেন-সামান্য যা অবশিষ্ট আছে তা উদ্ধার করতে। বিভিন্ন সংস্থা ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে কিছু সহায়তা মিললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তারা জানান, চারদিকে কংক্রিট ছাড়া যেন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। ভয়াবহ আগুন প্রায় সবকিছুই শেষ করে দিয়েছে।

সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন? কড়াইল বস্তির অগ্নিকা-ের ঘটনায় আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে কিছু তথ্য মিলেছে। বস্তির বৌবাজারের কুমিল্লা পট্টির মিন্টুর বাসার ভেতরে প্রথমে একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য ঘরে। বস্তিটির প্রায় প্রতিটি ঘরেই কমবেশি গ্যাসের সিলিন্ডার ছিল। ফলে অনেক ঘর থেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গতকাল বুধবার দুপুরে পোড়া বস্তির বিভিন্ন অংশ ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী, এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রায় ২৪ ঘণ্টা হতে চলেছে। এই আগুনে পুড়েছে কয়েক শতাধিক ঘরবাড়ি। ক্ষতিগ্রস্তরা এখন খোলা আকাশের নিচে বসে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ পোড়া টিন, মালপত্র সরাচ্ছেন। বস্তিবাসী ও স্থানীয়রা বলেন, আগুন প্রথম লাগে বৌবাজারের বাসিন্দা মিন্টুর ঘর থেকে। মিন্টু ২০টি ঘর ভাড়া দিতেন। প্রতিটিই পুড়ে ছাই হয়েছে। তবে তার বাসার পাশে নতুন কিছু ইটের ঘর উঠতে দেখা গেছে। আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মঙ্গলবার বিকেলের দিকে প্রথম আগুন লাগে মিন্টুর বাসায় থাকা একটি সিলিন্ডারে। আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেটি বিস্ফোরণ ঘটে। মুহূর্তেই তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ঘরে। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে কয়েক শতাধিক ঘরে। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুই বের করতে পারেননি। মিন্টু মিয়ার ছোট ছেলে শুকুর আলী বলেন, আমাদের ঘরে প্রথমে আগুন লাগে। পরে একটি সিলিন্ডারে আগুন ধরে। এরপর সেটি বিস্ফোরণ হয়। তিনি বলেন, আমরা তখন দুই ভাই বাইরে ছিলাম। মা-বাবা ঘরে ছিলেন। বাবা অসুস্থ, এখন হাসপাতালে। আমাদের ২০টি ঘর পুড়েছে। অন্যদেরও সব পুড়ে ছাই। ঘটনাস্থলে মিন্টুর পোড়া একটি মোটরসাইকেলও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আগুনের সময় তিনি গার্মেন্টস কারখানায় ছিলেন। খবর পেয়ে ছুটে এসে দেখেন সব শেষ। তিনি দাবি করেন, তার বাবা বস্তির শুরু থেকেই এখানে বসবাস করেন। তাদের ঘরের সামনে পাপড়, পিয়াজু ও চায়ের দোকান চালাতেন। আগুন লাগার সময় তারা কিছুই বের করতে পারেননি। ঘরে যা ছিল সব পুড়ে গেছে। মিন্টুর ঘরগুলোতে ভাড়ায় থাকা ব্যক্তিরা বলেন, নিচতলা ও ওপরে মিলিয়ে মিন্টুর ২০টি ঘর ছিল। এগুলোতে কুমিল্লা, শেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ ভাড়ায় থাকতেন। অনেকেই ১০ থেকে ৩০ বছর ধরে সেখানে থাকছেন। প্রতিটি রুমের ভাড়া ছিল সাড়ে তিন হাজার থেকে চার হাজার টাকা। আগুন লাগার সময় তারা কিছুই নিতে পারেননি; এক কাপড়েই বের হন।

কড়াইল বস্তির একটি ভাড়া বাসায় সাত বছর ধরে বাস করতেন বনানীর একটি বিপণিবিতানের কর্মী আবুল খায়ের। যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, ঠিক পাশে তার বাসা ছিল। আগুনে তার বাসার কোনো চিহ্ন নেই। ঘরের সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে যাওয়া ঘরের এক কোণে মন খারাপ করে বসে আছেন আবুল খায়ের। সঙ্গে তার স্ত্রী নাসরিন দাঁড়িয়ে আছেন। কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না তারা। এক পর্যায়ে আবুল খায়ের বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) যখন আগুন লাগে, আমি বনানীতে ছিলাম। স্ত্রীও বনানীর একটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে। সে কাজ শেষ করে বিকেল চারটায় বাসায় যায়। এর কিছু সময় পর বস্তিতে আগুন লাগে। তখন স্ত্রী মোবাইলে কল দিয়ে আমাকে বিষয়টি জানায়। ছুটে গিয়ে দেখি, আমার ঘরেও আগুন জ্বলছে। ঘর থেকে কোনো মালামাল বের করতে পারিনি। আমার সাজানো সংসার এক মুহূর্তে ছাই হয়ে গেল। এ সময় পাশে থাকা নাসরিন বলেন, আগুন লাগার পর দেখি, বস্তির সবাই চারদিকে দৌড়ঝাঁপ করছে। বাচ্চাগুলো চিৎকার করছে। আগুন নেভাতে কোথাও পানির ব্যবস্থা নেই। এমন দৃশ্য দেখে আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘর থেকে আসবাবপত্র বের করে কোথায়, কীভাবে নেবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কোনো রকমে মোবাইলটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছি। পরে স্বামী এলেও আগুনের কারণে ঘরে ঢুকতে পারেনি। চোখের সামনে সব পুড়ে গেল।

কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার প্রায় ৪০ মিনিট পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে জানিয়ে নিলুফা আক্তার নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, বস্তিতে কী কারণে আগুন লেগেছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে আগুন মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই নিজের জীবন বাঁচাতেই দৌড়ে চলে যান। কিন্তু আগুন নেভাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আবার আগুন নেভাতে পানির ব্যবস্থাও ছিল না। রাতে আগুন লাগার পর ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারিনি। রাতের খাবারটা বিকেলেই রান্না করে রাখা হয়েছিল। সে খাবারটাও ছাই হয়ে গেছে। পকেটে টাকা না থাকায় রাতে খাবারও কিনতে পারিনি। তবে মধ্যরাতে বস্তিবাসীর মাঝে খাবার বিতরণ করেছেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তখন তিন প্যাকেট খিচুড়ি পেয়েছি। এগুলোই আমরা পাঁচজনে খেয়ে রাত পার করেছি। এখন কী খাবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। রাস্তায় কারও কাছে সাহায্যও চাইতে পারছি না। অথচ পাশেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) নগর ভবন। তারা তেমন কোনো সহযোগিতা করছে না। এদিকে, কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। আগুন লাগার খবর পেয়ে মঙ্গলবার রাতে তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন, তাদের খোঁজ-খবর নেন এবং সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে অবহিত হয়ে তাদের সহায়তা করেন। ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম দোলন জানান, রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। বস্তির ঘিঞ্জি এলাকা এবং পানির সমস্যা থাকায় আগুন নেভানোতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবে ১৯টি ইউনিট কাজ করেছে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

তদন্ত কমিটি: রাজধানীর গুলশানে কড়াইল বস্তিতে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পর এমন তদন্ত কমিটি গঠনের ব্যাপারে জানালো ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া বিভাগ। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, কমিটিতে তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পাঁচজন সদস্য রয়েছেন। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) মো. মামুনুর রশিদ সভাপতি এবং ঢাকা জোন-২ এর উপসহকারী পরিচালক অতীশ চাকমা, তেজগাঁওয়ের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. নাজিম উদ্দিন সরকার, ঢাকা-২৩ এর ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর সোহরাব হোসেন ও সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামানকে সদস্য করা হয়েছে।