* ওষুধ শিল্পে ক্ষতি ছাড়াতে পারে ৪ হাজার কোটি টাকা
* ইএবি’র দাবি ১২ হাজার কোটি টাকা
* বিজিএমইএ দাবি করেছে শত কোটি টাকা
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির পরিমাণ কত? আগুন নির্বাপনের পর আমদানি কারক ও বিভিন্ন শিল্প মালিকরা তাদের কাঁচামালের ক্ষতির পরিমান জানাচ্ছেন। একশ কোটি টাকা থেকে এ ক্ষতির পরিমান সর্বশেষ ১২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। রোববার এক বিজ্ঞপ্তিতে একশ’ কোটি টাকার একটি হিসেব দেয়। এরপর বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেদের ক্ষতির পরিমাণ জানানো হচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার ওষুধ শিল্পের ক্ষতির ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। যদিও তারা বলছে তাদের ২০০ কোটি টাকার পণ্য পুড়েছে।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে-এসব তাদের নিজস্ব হিসেব। এখন পর্যন্ত তদন্ত করে প্রকৃত ক্ষতির কোনো পরিমান জানানো হয়নি। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানেরই ইন্সুরেন্স করা আছে। ক্ষতিপূরণের জন্য নিজেদের মতো হিসেব দিচ্ছে কেউ কেউ। ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য কমিটি তদন্ত শেষ করে প্রকৃত ক্ষতির পরিমান আনুষ্ঠানিকবাবে প্রকাশ করবে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন (পণ্য রাখার স্থান) লাগে গত শনিবার। এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। তবে প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য ও কাঁচামাল পুড়ে গেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতে পারে বলেও উল্লেখ করছেন তারা। এরপর বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকা-ের ঘটনায় ১ বিলিয়ন ডলার বা ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)।
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে দেশের ওষুধ শিল্পে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। ইতোমধ্যে শীর্ষ ৪৫টি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বাপি)। অ্যান্টিবায়োটিক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস ও ভ্যাকসিনসহ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে দাবি করে বাপি বলছে, সামগ্রিকভাবে এই ঘটনার অর্থনৈতিক প্রভাব প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এক জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য জানান বাপির মহাসচিব ডা. মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ১৮ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে দেশের ওষুধ শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ভস্মিভূত হয়েছে। এই আকস্মিক ক্ষতি পুরো খাতকে বহুবিধ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।
ডা. জাকির বলেন, দেশে বর্তমানে ৩০৭টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এর মধ্যে সক্রিয়ভাবে উৎপাদনে আছে প্রায় ২৫০টি কোম্পানি। বাপির প্রাথমিক জরিপ অনুযায়ী, শুধু শীর্ষ ৪৫টি কোম্পানিরই প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাঁচামাল পুড়ে গেছে। অন্য কোম্পানিগুলোর ক্ষতির হিসাব যুক্ত হলে মোট ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হবে। তিনি আরও বলেন, অগ্নিকা-ে পুড়ে যাওয়া কাঁচামালের মধ্যে ছিল অ্যান্টিবায়োটিক, ভ্যাকসিন, হরমোন, ডায়াবেটিক ও ক্যান্সার জাতীয় ওষুধ তৈরির উপকরণ। শুধু তাই নয়, কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেয়ার পার্টস ও মেশিনারিজও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা পুনরায় আমদানি করা সময়সাপেক্ষ। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি রপ্তানি সময়সূচিও প্রভাবিত হবে। বাপি মহাসচিব বলেন, আমাদের ওষুধ শিল্প দেশের অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি মানসম্পন্ন ওষুধ ১৬০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশও রয়েছে। কিন্তু এই অগ্নিকা-ের ফলে উৎপাদন চেইনে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে।
তিনি বলেন, দেশের ওষুধ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামালের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে চীন, ভারত ও ইউরোপ থেকে। এসব কাঁচামালের একটি বড় অংশ জীবনরক্ষাকারী ওষুধ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, যা সাধারণত আকাশপথে আমদানি করা হয়। কার্গো ভিলেজে আগুন লাগায় এসব দামি কাঁচামাল ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্যদিকে, বিকল্প হিসেবে অন্য এয়ারপোর্টে নামানো পণ্যগুলোকেও নিয়ে উদ্বেগ আছে, কারণ সেগুলোকেও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। আরও জটিলতা দেখা দিয়েছে নারকোটিকস বিভাগের অনুমোদন নেওয়া পণ্যগুলো নিয়ে। ডা. জাকির হোসেন বলেন, এই পণ্যগুলো পুনরায় আনা অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ, কারণ এতে ধাপে ধাপে একাধিক অনুমোদন নিতে হয়। ফলে এই দিক থেকেও বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বাপির ধারণা, এই ক্ষতির প্রভাব সরাসরি কাঁচামালের বাইরে গিয়েও বিস্তৃত হবে। ‘একটি র-ম্যাটেরিয়াল হারালে সেই উপকরণে নির্ভরশীল প্রতিটি ফিনিশড প্রোডাক্টের উৎপাদনই অনিশ্চয়তায় পড়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে বলে আমরা অনুমান করছি’— বলেন ডা. জাকির হোসেন। তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতি দ্রুত তদন্ত, ক্ষতিপূরণের কার্যকর ব্যবস্থা এবং বিকল্প কার্গো ব্যবস্থাপনা জোরদার করার আহ্বান জানান।
এদিকে বিমানবন্দরে ‘কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে’ আগুনের খবর দ্রুতই পেয়েছিল বিমানবন্দরের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ দল। তবে অগোছালোভাবে রাখা পণ্যের স্তূপের কারণে তারা উৎসের কাছে গিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ পায়নি। দূর থেকে পানি ছিটিয়ে লাভ হয়নি। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।