রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে মাথায় পড়ে আবুল কালাম (৩৫) নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট মেট্রোস্টেশন-সংলগ্ন বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায়। তবে তিনি স্বপরিবারে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে থাকতেন। দূর্ঘটনার পরপরই বন্ধ হয়ে যায় মেট্রোরেল। এতে হঠাৎ করে দুর্ভোগ পড়ে মানুষ। তবে বেলা ২টার দিকে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাও পর্যন্ত মেট্রোরেলের আংশিক অংশ চালূ হয়। পরবর্তীতে প্রায় ৭ ঘন্টা পর শাহবাগ থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজসহ মন্ত্রণালয় এবং ডিএমটিসিএল-এর কর্মকর্তারা।
নিহতের স্বজন আরিফ হোসেন জানান, আবুল কালাম ঢাকায় একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করতেন। তিনি নিয়মিত কাজের সূত্রে নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীতে যাতায়াত করতেন। দুপুরে তার মোবাইল নম্বর থেকে অপরিচিত একজন ফোন করে দুর্ঘটনার খবর দেন। পরে তিনি হাসপাতালে গিয়ে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হন।
আবুল কালামের মৃত্যুর ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া, তার পরিবারের কোনো কর্মক্ষম সদস্য থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন উপদেষ্টা। ঘটনায় পর পরই মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে দুপুর ২টা নাগাদ শুধু দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন জানান, ‘নিহত আবুল কালাম আজাদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে পাঠিয়েছি। এছাড়া এ ঘটনায় আমরা আইনত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। নিহত আবুল কালাম আজাদ শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা। তার বাবার নাম জলিল চাকদার এবং মা হনুফা বেগম।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহত ওই ব্যক্তি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মেট্রোরেল চলার সময় হঠাৎ একটি বিয়ারিং প্যাড ওপর থেকে তার মাথায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। এই ঘটনার পর দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে দুপুর ২টা নাগাদ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত শুধু দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু থাকবে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এমডি ফারুক হোসেন বলেন, ‘বাকি অংশ চেষ্টা করা হবে রোববার চালু করার। তবে এই কাজ শেষ হতে একটু সময় লাগবে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, এ ঘটনায় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এছাড়া, তার পরিবারের কোনো কর্মক্ষম সদস্য থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘সেতু বিভাগের সচিব আবদুর রউফকে আহ্বায়ক করে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি । তারা আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। তারা আগের ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করবেন এবং কেন এই ঘটনা ঘটছে সেটা খুঁজে বের করবেন।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, ৪৩৩ নম্বর পিলারের যে অংশ থেকে বিয়ারিং প্যাডটি খুলে পড়েছে, সেই জায়গার ডায়ার একপাশে কিছুটা দেবে গেছে। তবে বিকেল ৩টার দিকে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের একটি কারিগরি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে মেরামতের কাজ শুরু করেছে।
কারিগরি দল পৌঁছালে জানা যায়, মেট্রোরেলের ঐ অংশ থেকে দুটি প্যাডই খসে পড়েছে। একটি নিচে ছিটকে পড়লেও বাকিটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পর্যবেক্ষণে আসা এক ইঞ্জিনিয়ার বলেন, আমরা উপরে গিয়ে দেখেছি যে সেখানে দুটি স্প্রিং প্যাডই মিসিং। সেটি উপরেও খুঁজেছি আমরা কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। প্যাড পড়ে যাওয়ায় উপরের ডায়া নিচের কলামের সাথে আটকে আছে। বাংলাদেশী ২ জন ইঞ্জিনিয়ার উপরে উঠে ডায়ার ভেতরের পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষণ শেষে একজন ইঞ্জিনিয়ার জানান, সেখানে স্প্রিং প্যাড বসানো ব্যতীত মেট্রোরেল চলাচল সম্ভব হবে না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সোয়া ১২টার দিকে বিরাট আকারের বিয়ারিং প্যাডটি ছিটকে পড়ে। এ সময় ফুটপাত দিয়ে ওই তরুণ ব্যাগ কাঁধে হেঁটে যাচ্ছিলেন। প্যাডটি তার মাথায় আঘাত করে পাশের একটি চাপ-শিঙাড়ার দোকানে আঘাত করে। এতে ওই দোকানের সামনের কাঁচ ভেঙে দুইজন আহত হন। আর মাথায় আঘাত লাগা ওই তরুণ ঘটনাস্থলেই তাৎক্ষণিক মারা যান। নিচে পড়া স্প্রিংটির ওজন ৪০-৫০ কেজি হবে বলে উল্লেখ করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
সূত্র জানায়, বিয়ারিং প্যাড বিশেষ ধরনের রাবার দিয়ে তৈরি উপাদান। এটি পিয়ার ও ভায়াডাক্টের সংযোগস্থলে বসানো হয়। এসবের একেকটির ওজন ১৪০ থেকে ১৫০ কেজি। এসব বিয়ারিং প্যাড ছাড়া ট্রেন চালালে উড়াল পথ দেবে যাওয়া কিংবা স্থানচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর আগেও ফার্মগেট ও বিজয় সরণির একটি অংশে একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। ওই ঘটনায় বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি হয়। এর মধ্যেই দ্বিতীয়বার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে একজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটল।
এদিকে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে দুর্ঘটনার পর নিরাপত্তা নিয়ে যেসব উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সম্ভাব্য নকশাগত ত্রুটির কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা জানান, মেট্রোরেল লাইনের বাঁকে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে এবং সেখানেই প্যাডটি খসে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সম্ভাব্য নকশাগত ত্রুটির কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা জানান, মেট্রোরেল লাইনের বাঁকে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে এবং সেখানেই প্যাডটি খসে পড়েছে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, “যেখানে ট্রেন বাঁক নেয়, সেখানে চাপ বেশি থাকে। কিন্তু নকশাতেই হয়তো এই অতিরিক্ত চাপের বিষয়টি বিবেচনা করা হয়নি।” তিনি আরও বলেন, “বিয়ারিং ধরে রাখার জন্য রাবারের প্যাডটি ভালোভাবে আটকানো ছিল না। ফলে এটি অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে পারেনি।” ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে তিনি আরও চাপ সহনশীল ও উন্নত প্রযুক্তির ‘পড বিয়ারিং’ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বিয়ারিং প্যাডের কাজ ব্যাখ্যা করে বলেন, “যখন ট্রেন চলে যায়, তখন এটি কিছুটা সংকুচিত হয় এবং ট্রেন চলে গেলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। যদি প্যাডটি তার কার্যকারিতা হারায় বা পড়ে যায়, তাহলে কাঠামোর মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়।” তিনি আরও জানান, এই প্যাডগুলো ভূমিকম্পের সময়ও কাঠামোকে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করে।
বিয়ারিং প্যাডের কাজ কী?
বিয়ারিং প্যাডগুলো পথের বাঁকানো অংশে বসানো থাকে, যেখানে ট্রেন যাওয়ার সময় কাঠামোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। এই প্যাডগুলো কেবল ট্রেনের ওজনই বহন করে না, বরং ট্রেন চলার সময় সৃষ্ট কম্পনও শোষণ করে।
যখন একটি বাঁকে বিয়ারিং প্যাড অকেজো হয়ে পড়ে, তখন পিলারের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়। এতে কাঠামোগত ক্ষতি বা এমনকি ধসের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। এই প্যাডগুলো ভাইব্রেশন, শক এবং ভূমিকম্পের মতো পরিস্থিতি থেকেও সুরক্ষা দেয়। তাই এগুলো ঠিকমতো কাজ না করলে ট্রেন এবং নিচের রাস্তায় থাকা মানুষজন মারাত্মক বিপদের মধ্যে পড়েন।
ব্যবস্থাগত যেসব সমস্যা আগে চিহ্নিত হয়েছিল :
এর আগেও মেট্রোরেল ব্যবস্থায় বেশ কিছু বড় ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছিল। উড়ালপথের যেসব জায়গায় বেশি চাপ পড়ে, সেখানকার জন্য নকশাটি যথেষ্ট মজবুত ছিল না। বিশেষজ্ঞরা রাবারের বদলে আরও টেকসই ধাতব পদার্থ ব্যবহারের সুপারিশ করেছিলেন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা সনদ ছাড়াই মেট্রো চলছিল, যা ছিল বেআইনি। মেট্রো চালু হওয়ার পর থেকে ডিটিসিএ-এর কাছে কোনো নিরাপত্তা প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।মেট্রোরেল বা যাত্রীদের জন্য কোনো বিমা ছিল না। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না।
তদন্তের জন্য গঠিত সাত সদস্যের একটি কমিটি চাপ ও নড়াচড়া পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা বসানোর সুপারিশ করলেও নকশাগত ত্রুটির বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি।তবে কর্তৃপক্ষ নকশাগত ত্রুটির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিল, বিভিন্ন কারণে এই ঘটনা ঘটতে পারে।
ডিএমটিসিএল একটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিরাপত্তা সনদ পাওয়ার চেষ্টা করছিল এবং জীবন বীমা কর্পোরেশনের সাথে বিমা চালুর বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছিল
পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন :
রোববার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়।
কমিটিকে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হলেন মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফ। কমিটিতে কারিগরি ও প্রকৌশলগত পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এবং সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের (এমআইএসটি) বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক এ বি এম তৌফিক হাসান, এমআইএসটি-এর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহিদুল ইসলাম এবং ডিএমটিসিএল-এর লাইন-৫-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন উপসচিব আসফিয়া সুলতানা।
আর নারয়ণগঞ্জে ফিরবেন না আবুল কালাম :
মাত্র ৩৫ বছর বয়স। কত শত স্বপ্ন নিয়ে আবুল কালাম ছুটছিলেন নিষ্ঠুর এই শহরে কে জানে। এই রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা দিতে পারেনি। ফুটফুটে সন্তানরা তার নিথর দেহটি দূর থেকে দেখেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আবুল কালাম ট্রাভেল এজেন্টে এয়ার টিকিট বিক্রির কাজ করতেন। তার তিন ও চার বছর বয়সী দুটো ছেলে রয়েছে। পরিবার নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জে। ঢাকায় কাজের খাতিরে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে রাজধানীতে আসতেন আবুল কালাম (৩৫)। রোববার (২৬ অক্টোবর) সকালেও যেমনটি করেছিলেন, সেদিনও বের হয়েছিলেন নিয়মিত যাত্রায়। কিন্তু কে জানত, সেটিই হবে তাঁর জীবনের শেষ দিন।
রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেল প্রকল্পের একটি পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে গেলে সেটির আঘাতে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান এই যুবক।
আবুল কালামের বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। স্থানীয় জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা–মাকে কিশোর বয়সেই হারান তিনি। এরপর বড় ভাইবোনদের কাছে মানুষ হন। জীবনের শুরু থেকেই কঠোর পরিশ্রম আর সংগ্রাম ছিল তাঁর সঙ্গী।
সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে ২০১২ সালে মালয়েশিয়া যান আবুল কালাম। সেখানে কয়েক বছর কাজ করে ফিরে আসেন দেশে। পরে ২০১৮ সালে পাশের গ্রামের আইরিন আক্তারকে বিয়ে করেন। তাঁদের সংসারে রয়েছে ছয় বছরের এক ছেলে ও চার বছরের এক মেয়ে। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের পাঠানটুলী এলাকায় ভাড়া থাকতেন তিনি। ঢাকার মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। প্রতিদিন সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় যেতেন কাজের জন্য।
হঠাৎ মৃত্যুর খবরে শোকে স্তব্ধ আবুল কালামের গ্রামের বাড়ি শরিয়তপুরের ঈশ্বরকাঠি গ্রাম। চার ভাইয়ের টিনের ঘরের একটি ঘর ছিল আবুল কালামের। ঘরটি এখন তালাবদ্ধ। বড় ভাই খোকন চোকদারের ঘরে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন বড় বোন সেলিনা বেগমসহ স্বজনেরা। শোকে মুহ্যমান গ্রামের মানুষ ও বন্ধুরাও ছুটে এসেছেন তাঁদের সান্ত¡না দিতে।
আবুল কালামের শৈশবের বন্ধু রিহিনুজ্জামান বলেন, ‘এক মাস আগে যখন গ্রামে এসেছিল, তখনও হাসিখুশি ছিল। এমনভাবে চলে যাবে, তা ভাবতেই পারছি না।’
বড় বোন সেলিনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ভাইটা ছোটবেলা থেকেই কষ্ট করেছে। বাবা–মা নেই, এখন দুই বাচ্চা রেখে সেও চলে গেল। কে দেখবে এখন ওর বাচ্চাগুলোকে? আল্লাহ, কেন এমন করলে আমাদের সঙ্গে?’
বড় ভাই খোকন চোকদার বলেন, ‘গত মাসে গ্রামের জমিজমার খোঁজ নিতে এসেছিল সে। কে জানত ওটাই তার শেষ আসা হবে! এখন সে ফিরবে প্রাণহীন দেহ হয়ে। আমাদের পরিবারের এ শোক আমরা কীভাবে সইব?