রাজধানীর মহাখালীতে কড়াইল বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকা- ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস একের পর এক ইউনিট বাড়িয়েও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকেও সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ওই বস্তির অনেকগুলো ঘর তখনও পুড়ছিল দাউ দাউ আগুনে। তবে এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আগুন লাগার কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে আগুনে শত শত কাঁচা ঘর ও আসবাবপত্র পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটের পাশাপাশি স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। তবে আগুন আশপাশে ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। ভয়াবহ এ আগুনে নিজের ঘর আর সহায় সম্বল পুড়তে দেখে হতবাক হয়ে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে ওই বস্তিতে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ প্রথমে সাতটি ইউনিট সেখানে আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন। সাড়ে ৬টার দিকে পর্যায়ক্রমে ইউনিট সংখ্যা বাড়িয়ে ১৬টি করার তথ্য দেন আরেক কর্মকর্তা। রাত ৮টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার এক বার্তায় জানান, আরও তিনটি ইউনিট সেখানে যোগ দিয়েছে। এ নিয়ে ১৯টি ইউনিট কাজ করছে। রাত সাড়ে ৮টার দিকেও বস্তিতে আগুন ক্রমান্বয়ে বাড়তে দেখা গেছে। প্রাথমিকভাবে আগুন লাগার কারণ বা ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস।
সন্ধ্যার আগুন যেন শুধু ঘরবাড়িই নয়, সাধারণ মানুষের আজীবনের সঞ্চয় আর স্বপ্নগুলোও গিলে খাচ্ছে। ঘনবসতিপূর্ণ এই বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই অনেকেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেদের ঘর হারালেন। অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়নি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে নেওয়ার। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানী লাগোয়া প্রায় ৯০ একর জায়গার ওপর ১০ হাজার ঘর রয়েছে এই বস্তিতে। এই বস্তিতে নি¤œ আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা বাস করেন। যেখানে প্রায়ই অগ্নিকা-ে ঘটে। এর আগেও এই বস্তিতে বিভিন্ন সময় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা সর্বস্ব হারিয়েছেন।
চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ওই বস্তিতে লাগা আগুনে পুড়ে যায় অন্তত ডজনখানেক ঘর। গত বছরের ২৪ মার্চ ও ১৮ ডিসেম্বরেও আগুনে পুড়ে কড়াইল বস্তি। প্রায় প্রতিবারই অগ্নিনির্বাপক বাহিনী জানিয়েছে, বস্তিতে ঢোকার রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে বেগ পেতে হয়। টিন, বাঁশ, কাঠের ঘরগুলো গায়ে গা লাগিয়ে ওঠানো হয়েছে; যার কারণে এখানে আগুন লাগলে দ্রুত ছড়ায়।
স্থানীয়রা জানান, পানি সংকটের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে কড়াইল বস্তির অনেক ঘর। স্বল্প আয়ের মানুষদের ঘর পুড়ে যাওয়ার কারণে তারা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
জানা গেছে, বাসিন্দাদের বস্তির ভেতরে যেতে দিচ্ছে না ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ও দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সেজন্য স্থানীয় বাসিন্দাদেরকে ঘটনাস্থল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া, বস্তিবাসী যেসব ঘরে এখনো আগুন লাগেনি কিন্তু আগুন লাগার আশঙ্কা রয়েছে, সেসব ঘর থেকে তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ মাথায় করে কিংবা হাতে করে তাদের জিনিসপত্র দুর্ঘটনার স্থল থেকে নিয়ে যেতে তৎপর হয়েছেন।
আগুনে ঘর পুড়ে যাওয়া বস্তির বাসিন্দা লাভলী বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার সব আগুনে পুড়ে শেষ। সাত বছর ধরে এই বস্তিতে আছি। অনেক কষ্টে তিল তিল করে জিনিসপত্র কিনেছিলাম। ঘরে টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র কিনেছিলাম। মাসে মাসে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হয়। এ আগুনে আমার সব শেষ হয়ে গেল। বস্তির বাসিন্দা লাকি আক্তার পোশাক কারখানায় কাজ করেন। তিনি বলেন, শুনেছি আমার ঘর পুড়ে গেছে। সব জিনিস নাকি পুড়ে গেছে। এখন আমি কীভাবে কী করব, বুঝতে পারছি না। একাধিক বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাকি ও লাভলীদের মতো অনেক নি¤œ আয়ের মানুষ বসবাস করে এই বস্তিতে। আজকের এই ভয়াবহ আগুনে অনেকের পথে বসতে হবে।
আকলিমা খাতুন নামে এক বাসিন্দা রাস্তার পাশে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কেঁদে কেঁদে তিনি বলেন, আমার কিছুই আনতে দিলো না। কষ্ট করে কিছু জিনিসপত্র কিনেছিলাম, সব শেষ হয়ে গেছে। আজিজ শেখ নামের একজন মাথায় টেলিভিশন ও হাতে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে বের হন। তিনি বলেন, ‘এ দুইডা জিনিস বাইর করতে পেরেছি। বাকিসব পুইড়া গেছে। চোখের সামনে সব পুড়ে গেলো’। স্কুলপড়ুয়া শিশু হাসান, তার কাঁধে একটি বড় বস্তা। সঙ্গে তার মা লিমা আক্তার দুই হাতে দুটি বড় ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছেন। হাসানের বাবা বাইরে কাজে থাকায় মা-ছেলে যতটুকু পারে, জিনিসপত্র উদ্ধার করছেন। লিমা আক্তার বলেন, কিছুই বের করতে পারি নাই। আমাদের ঘরেই আগুন লেগেছে। ছয় বছর ধরে বস্তিতে থাকি, দুইবার আগুনের শিকার হয়েছি। আগেরবার খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, কিন্তু এবার দামি আসবাবপত্র সব পুড়ে গেছে।