ট্রেনে কাটা পড়ে অহরহ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিনিয়ত ট্রেনে কাটা পড়ার ঘটনা ঘটছে। অবচেতন মনে রেললাইন দিয়ে হাটতে গিয়ে কিংবা হেড ফোন কানে দিয়ে অসতর্কতার কারণে প্রায়ই ঘটছে দুঘর্টনা। পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে ট্রেনে কাটা পড়ে ৪ হাজার ৬৩১জনের মুত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ হিসেব কাগজ কলমের। এর বাইরে অনেক ঘটনাই থাকে অজানা।
রেলের এমন দুর্ঘটনার বিষয়ে রেলপথে দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে এবং সর্বসাধারণকে সহযোগিতা প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। সোমবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম সিদ্দিকীর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সহযোগিতা চাওয়া হয়।
এতে বলা হয়, সম্প্রতি বিভিন্ন রুটে কয়েকটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাথমিক সতর্কতা ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে। প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে এসব দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সম্প্রতি কিছু ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, রেলপথে দুর্ঘটনার জন্য রেল সংশ্লিষ্টদের বাইরে কতিপয় ব্যক্তি/গোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে যা নাশকতার পর্যায়ে পড়ে।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত চার বছরে ঢাকা জেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ১ হাজার ৭৬৩ জন। এ সময়ে সারা দেশে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৩ হাজার ৯১৮ জন, অর্থাৎ ঢাকা জেলায় মারা যান এক-তৃতীয়াংশ মানুষ। রেলওয়ের ঢাকা জেলার মধ্যে পড়েছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, অসতর্কতা ও অসচেতনভাবে রেললাইন ব্যবহারের কারণে গত তিন বছরে মৃত্যু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ১৪০ জনে, অর্থাৎ এ সময়ে প্রতিদিন গড়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
আইন কি বলে?
রেললাইনে কাটা পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় কাউকে দায়ী করা হয় না। রেলওয়ে আইন-১৮৯০ অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া রেললাইন ব্যবহার অবৈধ। এ কারণে রেললাইনে মৃত্যু হলে নিহত ব্যক্তিকেই দায়ী করা হয়। রেললাইন সরকারিভাবে সাধারণের চলাচলের জন্য নয় বলে সার্বক্ষণিক ১৪৪ ধারা জারি থাকে। আইন ভঙ্গ করে রেললাইনে প্রবেশে দুর্ঘটনা ঘটলে তা ‘অপমৃত্যু’ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর দায়ভার কারও ওপর বর্তায় না।
রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর পেছনে মোটাদাগে চারটি কারণের কথা বলছেন রেলওয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এক, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় রেলক্রসিং দ্রুত পার হতে গিয়ে এবং রেললাইনের ওপর বসা বা চলাচলের কারণে। দুই, কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন পার হওয়া বা হাঁটার সময়। তিন. ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া। চার. রেললাইনকে ব্যবহার করে হত্যা ও আত্মহত্যা।
গত ১৬ জুলাই কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেনে কাটা পড়ে সাহেরা বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলায়। তিনি কমলাপুর এলাকায় ভিক্ষা করতেন বলে স্বজনেরা জানিয়েছেন।
গত ১৯ জুন চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলায় সোনাপাহাড় এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিরা হলেন আরাফাত, আনিস ও রিয়াজ। তবে তাদের বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
এলাকাবাসী জানান, সোনাপাহাড় এলাকায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনে তিনজন কাটা পড়েন। তারা পাঁচ বন্ধু রেল লাইনের ওপর বসে গল্প করছিলেন। বাকি দুইজন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন।
কুমিল্লার বুড়িচংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল বুধবার ভোরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের বুড়িচংয়ের বাকশিমুল ইউনিয়নের মাধবপুর এলাকায় ঘটনাটি ঘটে।
কুমিল্লা সদর জিআরপি আউট পোস্টের ইনচার্জ জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের চট্টগ্রামগামী ডাউন লাইনে অজ্ঞাতপরিচয় তিন কিশোর ভোররাতে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।
ট্রেন যাওয়া-আসার জন্য পাশাপাশি দুটি রেললাইন। একটি লাইনে দাঁড়িয়ে অন্য লাইনে আসা চলন্ত ট্রেনের ভিডিও করছিলেন এক তরুণ। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিলেন, হঠাৎ সেখান দিয়ে আরেকটি ট্রেন চলে আসে। এতে কাটা পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় ওই তরুণের। ঘটনাটি ঘটেছে গত ২ মে ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায়। নিহত তরুণের নাম ইশতিয়াক আহমেদ। তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী ছিলেন। খিলক্ষেতে খালার বাসায় তিনি বেড়াতে এসেছিলেন।
মৃত্যুর কারণ কানে হেডফোন
গত বছরের ২২ জানুয়ারি জামালপুরের মেলান্দহের রুখনাইপাড়া এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান শাকিল মিয়া ও মজিবুর রহমান নামের দুই তরুণ। তাঁরা কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনে বসে গান শুনছিলেন। ট্রেনের শব্দ শুনতে পাননি।
এভাবে রেললাইনে বসে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনা বা হেডফোন লাগিয়ে রেললাইন দিয়ে হেঁটে চলার কারণে প্রতিবছর অনেক মানুষ হতাহত হন। রেলওয়ে পুলিশের হিসাবে দেখা গেছে, গত এক দশকে কানে হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনে হাঁটা বা বসার কারণে ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর মারা গেছেন ১১২ জন।
হেডফোন লাগিয়ে রেললাইনে হাঁটা বা বসে থাকা ছাড়াও অনেকেই মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনে হাঁটতে থাকেন। এটাও ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। চলতি বছরের ১৮ মে ঢাকার উত্তরায় মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রেললাইনে চলে যান দক্ষিণখান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কে এম মনসুর আলী। এ সময় ট্রেন চলে এলেও তিনি সেটি খেয়াল করেননি। ট্রেনে কাটা পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
রেলওয়ে পুলিশের ভাষ্য , রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ট্রেন এলে অনেক সময় শব্দ আসে না। এর মধ্যে কানে হেডফোন বা মুঠোফোন থাকলে হুইসেল বাজালেও শব্দ ঠিকভাবে শোনা যায় না। ট্রেনের চালক সেটি খেয়াল করলেও কিছু করার থাকে না। কারণ, ট্রেন এমন একটা যান, চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা যায় না।
রেলওয়ে পুলিশ বলছে, বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রেললাইন সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। এর মধ্যে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় রেললাইনের একটি বাঁক রয়েছে। এতে এক পাশ থেকে ট্রেন এলে অন্য পাশে দেখা যায় না। ওই বাঁক দিয়ে প্রতিদিন বহু মানুষ যাতায়াত করলেও কোনো পদচারী–সেতু নেই।
রেলওয়ে পুলিশ বলছে, বনানী থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রেললাইন সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। এর মধ্যে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় রেললাইনের একটি বাঁক রয়েছে। এতে এক পাশ থেকে ট্রেন এলে অন্য পাশে দেখা যায় না। ওই বাঁক দিয়ে প্রতিদিন বহু মানুষ যাতায়াত করলেও কোনো পদচারী-সেতু নেই। ঝুঁকিপূর্ণভাবে দিনভর মানুষ যাতায়াত করেন। এখানেই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়। আবার এ এলাকা মহাসড়কের পাশে হওয়ার কারণে সব সময় উচ্চ শব্দ থাকে। এতে রেললাইন পার হওয়া বা রেললাইন দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ট্রেন এলেও মানুষ শব্দ শুনতে পান না।
ঢাকা জেলা রেলওয়ে পুলিশ বলছে, ঢাকা মহানগরীর মধ্যে কারওয়ান বাজার, খিলগাঁও, মগবাজার, মালিবাগ, গোপীবাগ এলাকাতেও ট্রেনে কাটা পড়ে বহু মানুষ হতাহত হন। এসব এলাকা থেকে প্রায়ই লাশ উদ্ধার হয়। এ ছাড়া গাজীপুর, টাঙ্গাইল ও নরসিংদীতেও ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।
রেলওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে মোট রেলক্রসিং আছে ৩ হাজার ১১১টি। এর মধ্যে অনুমোদন আছে ১ হাজার ৮৮৬টির। এ হিসাবে ১ হাজার ২২৫টির অনুমোদন নেই, অর্থাৎ দেশের মোট রেলক্রসিংয়ের প্রায় ৪০ শতাংশেরই অনুমোদন নেই। কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার বিভাগ রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই বলেই মনে করেন রেলওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে এ নিয়ে কেউ নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
কেউ দায় নিচ্ছেন না :
ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় নিহত ব্যক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অরক্ষিত রেলক্রসিং, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছেন। রেললাইনে হাঁটা বা বসা আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ। যাঁরা আইন মানছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। রেললাইনের নিরাপত্তার জন্য রেলওয়ে বিভাগের নিরাপত্তা বাহিনী রয়েছে। আইন অনুযায়ী তাঁরা গ্রেপ্তারও করতে পারেন। অথচ তাঁরা রেললাইনের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না।
রেলওয়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, অরক্ষিত রেলক্রসিং মৃত্যুর অন্যতম কারণ। এগুলো তদারকি ও রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া রেলওয়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এমনকি রেললাইনে যেন কেউ যেতে না পারে, সেটি দেখার দায়িত্বও রেলওয়ে বিভাগের।