রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়িতে উড্ডয়নের পর পরই বিধ্বস্ত হওয়া বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি দূর্ঘটনার পর বেরিয়ে আসছে নানা তথ্য উপাত্ত। এই যুদ্ধ বিমানটির রয়েছে নানা বৈশিষ্ট্যও। বিধ্বস্ত এফ-৭ বিজিআই বিমানটি মূলত চীনের তৈরি চেংদু জে-৭ সিরিজের একটি যুদ্ধবিমান। প্রস্তুতকারক চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন।

জানা গেছে, বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে কেনা এই যুদ্ধ বিমান। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২০১১ সালে ১৬টি যুদ্ধবিমান সরবরাহের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৩ সাল নাগাদ এই যুদ্ধবিমানগুলোর ডেলিভারি সম্পন্ন হয়। খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রের। জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে এই সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক মডেলের যুদ্ধবিমান সরবরাহের পর চীন এই সিরিজের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

বাংলাদেশে এই মডেলের বিমানের তৃতীয় দুর্ঘটনা এটি। এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরের রসুলপুরে ফায়ারিং রেঞ্জে মহড়ার সময় বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দিপু নিহত হন। এরপর ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ এমবি। এতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিহত হন।

এফ-৭ বিজিআই (যেখানে আই বলতে ইমপ্রুভড বা আগের ভার্সনের চেয়ে উন্নত বোঝানো হয়) যুদ্ধবিমানটি মূলত এফ-৭ বিজি-এর উন্নত রূপ, যার মূল ভার্সন জে-৭ জি। এই এফ-৭ বিজিআই মূলত বাংলাদেশের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছিল। এফ-৭ বিজির তুলনায় এফ-৭ বিজিআইয়ের বেশ কিছু চোখে পড়ার মতো আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এফ-৭ বিজিআইয়ে তিনটি মাল্টি ফাংশনাল ডিসপ্লে এবং আরও শক্তিশালী ফায়ার কন্ট্রোল রাডার রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর মোট ৩৬টি এফ-৭ যুদ্ধবিমান রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই এফ-৭ বিজিআই ভ্যারিয়েন্ট। তবে এফ-৭ এমবি ও এফটি-৭ ভ্যারিয়েন্টও রয়েছে। তবে মোট ফাইটার ভ্যারিয়েন্ট ৩৬টি।

লাইটওয়েট মাল্টিরোল ফাইটার ধরনের এই যুদ্ধবিমানগুলোর গতি সাধারণত মাক ২ দশমিক ২ বা শব্দের গতির অন্তত ২ দশমিক ২ গুণ। এগুলোতে আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র, লেজার গাইডেড বোমা, জিপিএস গাইডেড বোমা এবং বাড়তি জ্বালানি ট্যাংক ও অস্ত্র বহনের জন্য পাঁচটি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে। এই যুদ্ধবিমানগুলো ১ হাজার ৫০০ কেজির মতো ভার বহন করতে পারে।

এ ধরনের যুদ্ধবিমানের ককপিটে একজনমাত্র পাইলট বসতে পারেন। ককপিট সম্পূর্ণ কাচের। এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানে ব্যবহার করা হয়েছে কেএলজে-৬ এফ রাডার। এই যুদ্ধবিমান ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ মিটার বা ৫৭ হাজার ৪২০ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় উড়তে সক্ষম।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (মিলিটারি ব্যালেন্স-২০২৩ সংস্করণ), ফ্লাইট গ্লোবাল প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড এয়ার ফোর্স-২০২৩’ প্রতিবেদন, জাপান ডিফেন্স উইকলি ও চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের ডেটাশিট‘র প্রতিবেদন অনুসারে , বেশির ভাগ রাশিয়ার বিগ-২১ ও অন্যান্য সমসাময়িক অনেক যুদ্ধবিমানের চেয়ে এটি বেশি দ্রুত ম্যানুভার বা দিক পরিবর্তনে সক্ষম। এর পাল্লা কমবেশি ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার।

৩৪ বছরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ৩২টি বিমান দুর্ঘটনা

বিমানবাহিনীর বেশির ভাগ দুর্ঘটনা প্রশিক্ষণ চলাকালেই ঘটে, যা পিটি-৬, ইয়াক-১৩০, এল-৩৯ বা এফ-৭ টাইপ বিমানের ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে। প্রায় প্রতি দশকেই ফ্লাইট ক্যাডেট ও স্কোয়াড্রন লিডারদের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি,এক দিনেই ৪৪টি বিমান বিধ্বস্ত হয়। উত্তরার দুর্ঘটনা এ তালিকায় বিরল ও ভয়াবহ সংযোজন, যেখানে যুদ্ধবিমান সরাসরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হয়ে এতসংখ্যক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।

বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৯৯১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ৩৪ বছরে ৩২ টি বড় বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে উল্লেখযোগ্যযোগ্যসংখ্যক বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রাণহানি ঘটেছে। সেসব দূর্ঘটনাগুলো হচ্ছে, ৯ মে ২০২৪ ইয়াক-১৩০ প্রশিক্ষণ বিমান কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বিধ্বস্ত হয়। এতে স্কোয়াড্রন লিডার মুহাম্মদ আসিম জাওয়াদ নিহত হন। ২৩ নভেম্বর ২০১৮ এফ-৭ বিজি যুদ্ধবিমান টাঙ্গাইলে রকেট ফায়ারিং অনুশীলনের সময় বিধ্বস্ত হয়ে পাইলট নিহত হয়। ১ জুলাই ২০১৮ কে-৮ডব্লিউ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে দুইজন পাইলট নিহত হয়। ২ জানুয়ারি ২০১৮ মিল এমআই-১৭ হেলিকপ্টার শ্রীমঙ্গলে বিধ্বস্ত হয় কুয়েতি সামরিক কর্মকর্তাসহ। ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭ দুটি ইয়াক-১৩০ কক্সবাজারে বিধ্বস্ত হয়। ১১ জুলাই ২০১৭ ইয়াক-১৩০ চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় বিধ্বস্ত হয়, পাইলটেরা ইজেক্ট করেন। ২১ জুলাই ২০১৫ এমআই-১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জরুরি অবতরণকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৯ জুন ২০১৫ এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান পতেঙ্গা উপকূলে বিধ্বস্ত হলে ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট তাহমিদ নিহত হয়। ১৩ মে ২০১৫ এমআই-১৭১ এসএইচ হেলিকপ্টার শাহ আমানত বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়ে এক প্রশিক্ষক নিহত হয়। ৩০ এপ্রিল ২০১৪ পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ২০ মে ২০১৩ এল-৩৯ প্রশিক্ষণ বিমান যশোরে রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে। ১৪ জুলাই ২০১৩ ন্যাঞ্ছাং এ-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। ৮ এপ্রিল ২০১২ এল-৩৯ অ্যালবাট্রস জেট ট্রেনার, মধুপুরে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রেজা শরীফ নিহত। ২০ ডিসেম্বর ২০১০ পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বরিশালে বিধ্বস্ত হয়ে দুই স্কোয়াড্রন লিডার নিহত হয়। ২০১০ এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান পতেঙ্গায় বিধ্বস্ত। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১০ পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান কর্ণফুলী নদীতে বিধ্বস্ত। ২২ অক্টোবর ২০০৯ পিটি-৬ ট্রেনার বিমান বগুড়া সদরে বিধ্বস্ত। ১৬ জুন ২০০৯ এফটি-৬ যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত। ৮ এপ্রিল ২০০৮ এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান টাঙ্গাইলের পাহাড়িয়া গ্রামে বিধ্বস্ত হয়ে স্কোয়াড্রন লিডার মোরশেদ নিহত হয়। ৯ এপ্রিল ২০০৭ পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান যশোরে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট ক্যাডেট ফয়সাল মাহমুদ নিহত হয়। ২৪ এপ্রিল ২০০৬ পিটি-৬ কোটচাঁদপুর ঝিনাইদহে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট ক্যাডেট তানজুল ইসলাম নিহত হয়। ৭ জুন ২০০৫ এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান উত্তরায় বহুতল ভবনের সঙ্গে সংঘর্ষ। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত। ২০০৩ পিটি-৬ প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত। ১৫ নভেম্বর ২০০৩ পাইপার সেসনা এস-২ বিমান বিধ্বস্ত। ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ এফটি-৭বি বিমান বিধ্বস্ত। ১৯ অক্টোবর ২০০২ এমআই-১৭-২০০ হেলিকপ্টার কক্সবাজার উখিয়ায় বিধ্বস্ত হয়ে চারজন নিহত হয়। ৩০ জুলাই ২০০২ এ-৫সি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আদনান নিহত হয়। ৭ জানুয়ারি ২০০১ এফটি-৭বি ট্রেনার যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ মহসিন নিহত হয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৮ ন্যাঞ্ছাং এ-৫ সি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত। ২৬ অক্টোবর ১৯৯৮ এফ-৭এমবি বিধ্বস্ত। ৮ মে ১৯৯৬ একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত। ১৯৯৪ একটি এফ-৭ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত। ১৯৯৩ দুটি পিটি-৬ ট্রেনিং বিমান সংঘর্ষে তিনজন পাইলট নিহত। ১৯৯৩ একটি এফটি-৫ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কুদ্দুস নিহত হয়। ৩০ এপ্রিল ১৯৯১ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৪০টি এফ-৬ এবং চারটি মিল-৮ হেলিকপ্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস।