২০২২ সাল। ৪ জুন শনিবার রাতটা ছিল এক ভয়াবহ আর করুণ নিয়তির। সেদিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অজানা এক বিপদেই পড়ে যান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আগুন নেভানোর দায়িত্বটা পালন করতে গিয়ে নিজের জীবন সমূহ শংকার মধ্যে পড়লেও লড়ে যান শেষ পর্যন্ত। সেদিনকার একটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জন কর্মী অকালে প্রাণ হারান। সংস্থাটির পথচলার শুরু থেকে একদিনে একসাথে এতোকর্মী হারানোর বেদনাবিধুর ঘটনা এটাই প্রথম। যদিও সংস্থাটির কর্মীরা নানা ঘটনায় হতাহতের শিকার হচ্ছেন প্রতিবছরই কমবেশি। ১৯৬৬ সালের পর থেকে এ যাবত ৬০ বছরে ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন পর্যায়ের ৫০ জন কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। সংস্থাটির হিসেবে, গত ১০ বছরেই মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। এ সময়ে কমবেশি আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন।
ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টির ইতিহাসে সবচে বড় হৃদয়বিদারক ঘটনা চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাতের আধাঁরে অগ্নিকা- ও ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীসহ ৫১ জন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হন। যাদের অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছেন। সেদিন আশেপাশের জেলার ২৫টি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট সেইসাথে সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর চেষ্টায় ৮৬ ঘণ্টায় ডিপোর আগুন নেভে। এ ঘটনার পর আজও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাননি আহতদের কয়েকজন। আবার বিচার নিয়েও হতাশ হতাহতের স্বজনরা।
ওই ঘটনার পেছনে ডিপোর মালিক-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠলেও প্রাথমিক পর্যায়েই কর্তৃপক্ষকে দায়মুক্তি দিয়ে সেখানকার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। মামলার এজাহারে কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়। প্রথমত, ডিপো কর্তৃপক্ষ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ না নিয়ে ডিপোতে বিপদজনক রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, অগ্নিকা-ের পর উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের রাসায়নিক মজুদ থাকার বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। তৃতীয়ত, এই মজুদ রাসায়নিক পদার্থের কারণেই অগ্নিকা- ও বিস্ফোরণে মৃত্যু ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অভিযুক্তদের অবহেলায় জানমাল ও সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে।
বিএম ডিপোতে শুরুতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটিয়ে তা নেভানোর চেষ্টা করেছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় একের পর এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। কম্পন পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত অনুভূত হয় এবং এর প্রভাবে আশপাশে ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। দুর্ঘটনার পর একাধিক সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে আসে তাদের নিরাপত্তা ঘাটতিসহ নানা গাফিলতির চিত্র। আগুন নেভাতে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগে থেকে কনটেইনার ভর্তি ভয়াবহ রাসায়নিক পদার্থের বিষয়ে জানানো হয়নি বলেও অভিযোগ ওঠে। এসব কারণেই একদিনে এতো সংখ্যক দক্ষ কর্মীকে অকালে হারায় ফায়ার সার্ভিস। এর আগে কখনো একটি ঘটনায় এত অগ্নিনির্বাপণকর্মীর মৃত্যু হয়নি।
সর্বশেষ গাজীপুরের টঙ্গীতে দগ্ধ ফায়ার সার্ভিসের দু‘জন কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে একই ঘটনায়। যদিও দু‘জনের মৃত্যু হয়েছে একদিন পর পর। কেমিক্যাল কারখানায় লাগা আগুনে দগ্ধ ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদা (৩৮) চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বেলা ২টা ৪০ মিনিটে ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মারা যান। এর আগের দিন মঙ্গলবার দগ্ধ কর্মী শামীম আহমেদ (৪০) জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার শরীরের শতভাগ পুড়ে গিয়েছিল বলে তথ্য দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। তিন সন্তানের জনক শামীমের বাড়ি নেত্রকোনা। এ নিয়ে টঙ্গীর কেমিক্যাল কারখানার আগুনে দগ্ধ চার ফায়ার ফাইটারের মধ্যে দুজনের মৃত্যু হলো। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে গেলে একাধিক ফায়ারফাইটার দগ্ধ হন। এদের মধ্যে ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদাও ১০০ শতাংশ বার্ন হয়েছিলেন। নুরুল হুদা টঙ্গী ফায়ার স্টেশনে কর্মরত ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ ফায়ার সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন তিনি। তার ছেলের বয়স ৩ বছর আর মেয়ে ৫ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা বলে জানা গেছে। বর্তমানে আরো দুইজন বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন। আলআমিন হোসেন বাবু নামে ফায়ার সার্ভিসের আরও একজন কর্মী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি আছে। তার শরীরের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। আলআমিনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাষ্ট্রের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস। আগুন লাগার পর নেভানোর জন্য ছুটে গিয়ে জীবন বাজি রেখে তারা কাজ করছেন। কিন্তু আগুন যদি কেমিক্যালের কারণে হয় তবে ফায়ার ফাইটারদের নিশ্চিত মৃত্যু হতে পারে। তবে আগুন লাগা স্থানে কেমিক্যালের উপস্থিতি আছে কি না অথবা দাহ্য পদার্থ রয়েছে কি না- সে সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হয় না। এজন্য দেশের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভবনের প্রবেশ মুখে সাইনবোর্ড টানানো দরকার যে সেখানে কোন ধরনের মালামাল রয়েছে।
হতাহতের পরিসংখ্যান : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মিডিয়া সেলের দেয়া এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৬৬ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ৬০ বছরে সংস্থাটির ৫০ জন কর্মীর মৃত্যু ঘটেছে শুধুমাত্র অভিযানিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে। নিহত এসব কর্মীর মধ্যে নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট থেকে শুরু করে সিনিয়র স্টেশন অফিসার পর্যন্ত রয়েছেন। পরিসংখ্যান অনুসারে, একজন সিনিয়র স্টেশন অফিসার মারা গেছেন ২০২০ সালের এক ঘটনায়। ১৯৬৬ সাল থেকে সংস্থাটি তার অভিযানিক কার্যক্রমে কর্মীর হতাহতের পরিসংখ্যান সংরক্ষন করছে। সে বছরই মারা যান একজন স্টেশন অফিসার। এরপর ১৯৭১ সালে মারা যান একজন ফায়ার ফাইটার। ১৯৭৩ সালে মারা যান আরও একজন ফায়ার ফাইটার। এরপর দীর্ঘ কয়েক বছর পর ১৯৮১ সালে মারা যান একজন লীডার। পরিসংখ্যান মতে, লীডার মারা গেছেন ৭ জন, ফায়ার ফাইটার মারা গেছেন ৩৫ জন, চালক ৩ জন, ডুবুরী একজন ও নার্সিং অ্যাটেনডেন্ট একজন।
বিগত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযানিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে মারা গেছেন ২৫ জন কর্মী। তাদের মধ্যে ২০২২ সালেই একটি ঘটনায় মারা গেছেন সবোর্চ্চ কর্মী ১৩ জন। এ সময়ের মধ্যে কমবেশি আহত হয়েছেন ৩৮৬ জন। সবচে বেশি আহত হয়েছেন ২০১৬ সালে ৭২ জন, ২০২৩ সালে ৫৪ জন, ২০১৭ সালে ৪৭ জন। অন্যান্য বছরগুলোতেও আহত হওয়ার সংখ্যাটা কম নয়। ২০২০ সাল থেকেই হতাহতের ঘটনা নিত্যনৈমত্তিক। প্রতিবছরই এ ঘটনা ঘটছে। আর এ বছরগুলোতে মারা গেছেন গত ১০ বছরে মারা যাওয়া ২৫ জনের মধ্যে ২০ জনই। আর বাকী ৫ বছরে মারা গেছেন শুধুমাত্র ৫ জন।
পরিসংখ্যান মতে, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের হতাহতের ঘটনা বেশি ঘটছে অগ্নিকান্ড নির্বাপনের সময়। এছাড়া, ঘটনাস্থলে যাওয়ার পথে সড়ক দূর্ঘটনায় পতিত হয়েও মৃত্যুর সংখ্যা কম নয়।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, আমরা যখন আগুনের ভেতরে ঢুকি, তখন নিজের কথা মাথায় থাকে না। মানুষের জীবন বাঁচানোই আমাদের মূল চিন্তা। কিন্তু সেই ঝুঁকি আমাদের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার ফাইটারদের পরিবারে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা।
ঝুঁকি কমাতে বাড়তি সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ দরকার : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসায়নিক গুদাম বা শিল্প এলাকায় অগ্নিকা-ের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়। উন্নত প্রটেক্টিভ গিয়ার, শ্বাসনালী সুরক্ষা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে প্রাণহানি কমানো সম্ভব। সংস্থাটির সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ইঞ্জিনিয়ার আলী আহম্মেদ খান বলেন, রাসায়নিক অগ্নিকা-ে কাজ করার জন্য আমাদের আরও উন্নতমানের সরঞ্জাম দরকার। অনেক সময় পোশাক ও অক্সিজেন সিলিন্ডারের মান যথেষ্ট না হওয়ায় দগ্ধ বা বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
পরিবারের জীবনে অসহায়তা : প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থেকে যায় একটি পরিবার, যারা হঠাৎ করেই জীবিকা ও নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস থেকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। সামাজিক নিরাপত্তা ও বিমা কাঠামো শক্তিশালী করা গেলে এ ধরনের বীরদের পরিবার কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে মনে করছেন ফায়ার ফাইটাররা।
সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর একটি জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন বৃটিশ সরকার অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯-৪০ অর্থ সালে ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন। বিভক্তিকালে আঞ্চলিক পর্যায়ে কলকাতা শহরের জন্য কলকাতা ফায়ার সার্ভিস এবং অবিভক্ত বাংলায় বাংলার জন্য (কলকাতাবাদে) বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস সৃষ্টি করেন। ১৯৪৭ সনে এ অঞ্চলের ফায়ার সার্ভিসকে পূর্ব পাকিস্তান ফায়ার সার্ভিস নামে অভিহিত করা হয়। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভারতে বে-সামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ প্রাথমিক পর্যায়ে অরৎ জধরফ চৎবপধঁঃরড়হং (অজচ) এবং পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫১ সনে আইনি প্রক্রিয়ায় সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর সৃষ্টি হয়। কর্মব্যবস্থাপনার জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীন রেসকিউ বিভাগ নামে ১টি বিভাগ সৃষ্টি হয়। ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল তৎকালীন ফায়ার সার্ভিস পরিদফতর ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর একীভূত হয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরে পরিনত হয়। পরবর্তীতে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীন রেসকিউ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরে অর্ন্তভুক্ত হয়।