মাত্র চারদিনের ব্যবধানে দেশে ভয়াবহ তিনটি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় ভয়াবহ আগুনে ১৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। গত বুধবার দুপুরে লাগা এ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে প্রায় ২৭ ঘণ্টা পর।
এ ঘটনার একদিন পরই চট্টগ্রামে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে এই আগুন লাগে এবং সাততলা ভবনের উপরের তলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনার একদিন পর গতকাল শনিবার দুপুরে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। পরপর তিনটি ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে। দু‘টি শিল্প কারখানার আগুনের পর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো একটি সুরক্ষিত স্থানে নজিরবিহিন অগ্নিকান্ডের ঘটনা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করছেন ঘটনাগুলো কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক। প্রশ্ন উঠছে- একের পর এক এসব অগ্নিকা- কি কেবলই অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা, নাকি এতে নাশকতার যোগসূত্র রয়েছে?
মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এক বিবৃতিতে ঢাকার রূপনগরে আনোয়ারা ফ্যাশন’পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ে নিহত, আহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের সঠিক তালিকা প্রকাশ করে ভিক্টিম এবং তাদের পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দেবার ও পুনর্বাসন এবং সরকারকে ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা রোধে দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে তদন্তের ফলাফল দ্রুত জনসমক্ষে প্রকাশ এবং এই ঘটনায় জড়িত সকল ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনার জন্য অধিকার সরকারের প্রতি আহবান জানায়। গত ১৪ অক্টোবর ঢাকার মিরপুরের শিয়ালবাড়ী এলাকায় তিনতলা ভবনে স্থাপিত ‘আনোয়ারা ফ্যাশন’ নামে একটি তৈরী পোশাক কারখানায় ও টিনশেড ঘরে থাকা রাসায়নিকের গুদামে এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১৬ জন শ্রমিক নিহত ও ১০ জন শ্রমিক আহত এবং শিশু শ্রমিকসহ অনেক শ্রমিক এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে। ভবন ও রাসয়ানিক গোডাউন কোনটিরই ফায়ার সেফটি লাইসেন্স ছিল না এবং অগ্নিনির্বাপনেরও কোনো ব্যবস্থা ছিল না। উপরন্তু অগ্নিকা-ের সময় ভবনের ছাদের গেট তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছিল। ফলে শ্রমিকরা বের হতে না পেরে সেখানে আটকা পড়েন। যে পোশাক কারখানায় অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে, তা তৈরি পোশাক শিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য ছিল না।
এই ধরনের ঘটনা রোধ করার লক্ষ্যে আইনগত এবং নীতিগত কাঠামো থাকা সত্বেও কারখানাগুলো তৈরির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও ত্রুটি এবং কারখানা পরিদর্শন পরিচালনা সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
অগ্নিকা-ের সময় কারখানাগুলোতে বহির্গমন পথ বন্ধ থাকা, অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের অভাব বা না থাকা এবং বিভিন্ন ধরনের অবহেলার কারণে কারখানায় বহু শ্রমিক নিহত ও আহত হয়েছেন। এই হতাহতের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশের কোন বিচার হয়নি এবং ভিকটিম/পরিবারের অধিকাংশই ক্ষতিপূরণ পাননি। অতীতে দেখা গেছে এই সব কারখানার মালিকেরা ক্ষমতাধর হওয়ায় বিচার পাননি ক্ষতিগ্রস্তরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক ‘দুটো দিকই মাথায় রেখে সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আগের বড় বড় আগুনের ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত’ কারণ বিষয়টি বারবার দেখা যাওয়ার পরেও বিচারের মুখোমুখি করতে দেখা যায়নি। বিচারহীনতার কারণে যারা দায়ী তারা সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। ফলে যেকোনও দুর্ঘটনা এড়াতে তার যেসব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, তা তারা নেয় না। বিশ্লেষকদের মতে, ধারাবাহিকভাবে এধরনের অগিকা-ের কারণ হিসেবে নাশকতা একটি কারণ হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে দুধরনের বিষয় ঘটে থাকে। এক অবহেলাজনিত ও আরেক নাশকতামূলক। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিটা ক্ষেত্রে দায়িত্বের জায়গায় একধরনের অবহেলা লক্ষ্য করা যায়। কন্টেইনারে কী বস্তু থাকবে এবং সেটা কীভাবে রাখা হবে; তা নিয়ে কোনও মনিটরিং থাকবে না- তা তো হতে পারে না। কেননা সেই অনুযায়ী সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা। বিচারহীনতাকে কারখানায় ঘনঘন অগ্নিকা-ের অন্যতম কারণ উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ। এরআগে তাজরীন ফ্যাশন, পুরান ঢাকার নিমতলী সবখানেই আগুনের পেছনে মালিকপক্ষের অবহেলা ছিল বলে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। পুরান ঢাকা থেকে এখনও কেমিক্যালের গুদাম সরানো সম্ভব হয়নি। একজন মালিককেও তার কাজের (অবহেলা) জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। ফলে সবচেয়ে দুর্বল হিসেবে শ্রমিকসমাজ বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে, হচ্ছে। নামমাত্র ক্ষতিপূরণেই চুপ থাকতে হচ্ছে তাদের। আর অন্যরা ঝুঁকি নিয়েই আবার নেমে পড়ছেন জীবনযুদ্ধে। আসলে তাদের জন্য কথা বলার কেউ নেই।
গত বছর ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনায় সাত নম্বর ভবনের প্রায় চারটি ফ্লোরে থাকা কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রাত ১টা ৫০ মিনিটের দিকে লাগা আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট প্রায় ৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর নিয়ন্ত্রণে আসে। দেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে এত বড় আগুনের ঘটনা কীভাবে ঘটলো, এটা নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা? এ নিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলসহ সাধারণ মানুষের মাঝেও আলোচনা, কৌতূহল ও প্রশ্ন সৃষ্টি হয়। যদিও এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি পরবর্তিতে জানায়, এ আগুন নাশকতা ছিল না। আগুনের প্রতিটি ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। প্রতিটি ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য কমিটিগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়। তবে অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন আসতেই দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত আলোর মুখ দেখে না। আবার প্রতিবেদনে তদন্তের ফলাফল সামনে এলেও দুর্ঘটনার সব দায় শেষ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি, ভবন ও কারখানা মালিকের ওপরই চাপানো হয়। সঠিক তদন্তের অভাবে ভুক্তভোগীরা বিচারও পায় না।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা আগুন লাগার ২০টি কারণ উল্লেখ করে বলছেন, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ, গ্যাস ও মাটির চুলা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, উত্তপ্ত ছাই, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, শত্রুতামূলক ও উচ্ছৃঙ্খল জনতার অগ্নিসংযোগ, বজ্রপাত ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বাজি পোড়ানো, মাত্রাতিরিক্ত তাপ, মেশিনের মিসফায়ার, স্বতঃস্ফূর্ত প্রজ্বলন, স্থির বিদ্যুৎ, রাসায়নিক বিক্রিয়া, সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ, গ্যাস সরবরাহ লাইনে আগুন, যানবাহনে দুর্ঘটনাজনিত আগুন, খোলা বাতির ব্যবহার ও অজ্ঞাত রহস্যজনক আগুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসচেতনতাই মূলত অগ্নিকা-ের কারণ।
এদিকে ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভয়াবহ এই আগুন লাগার ঘটনাকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই মনে করছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। শনিবার সন্ধ্যায় এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, স্বৈরাচারের দোসরদের খুঁজে বের করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনতে না পারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম বড় ব্যর্থতা। যার ফল বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে ভোগ করতে হবে। আগুন ঘটনা চক্রান্তের একটি অংশ উল্লেখ করে সারজিস আলম বলেন, বিভিন্ন জায়গায় আগুন লাগাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এগুলো স্বৈরাচারের দোসরদের দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তের অংশ। তথাকথিত তদন্ত কমিটির নাটক বাদ দিয়ে এর পেছনের প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা হোক।