রাজধানীর শাহবাগে ‘জুলাই, পিলখানা ও শাপলা চত্বর গণহত্যার বিচার এবং গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি’ শীর্ষক শহীদি সমাবেশে বুকভাঙা কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। তিনটি আলোচিত ঘটনার শহীদদের স্বজনরা সমাবেশে অংশ নিয়ে তাদের প্রিয়জনদের স্মরণে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন।

শুক্রবার (২৫ এপ্রিল) দুপুর তিনটার পর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে এই সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশের আয়োজন করে ইনকিলাব মঞ্চ। সমাবেশে বক্তারা আওয়ামী লীগকে ‘গণহত্যাকারী দল’ আখ্যা দিয়ে দলটি নিষিদ্ধের দাবি জানান।

এ সময় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি বলেন, আমরা কোনো রাজনৈতিক দল নই। আমার পরিবারের কেউ শহীদ হয়নি। কিন্তু আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, ইনকিলাব মঞ্চের একজন সদস্য বেঁচে থাকতে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করে ছাড়বে।

03-2504251413

হাদি বলেন, শহিদ জিয়ার বিএনপি, সাঈদী-নিজামীদের জামায়াতে ইসলামী কিংবা জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত এনসিপিকে দিল্লির দাসত্বে আটকাতে দেব না। ইনকিলাব মঞ্চ রক্তের শেষ বিন্দু পর্যন্ত প্রতিবাদ করে যাবে।

ওসমান হাদি হুঁশিয়ার করে বলেন, আগামী ১০০ দিন ৬৪ জেলায় গণসংযোগ করবে ইনকিলাব মঞ্চ। যদি এই সময়ের মধ্যে সরকার কার্যকর কোনো ভূমিকা না নেয়, তাহলে আগামী ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) শাহবাগ থেকে ‘মার্চ ফর বাংলাদেশ’ কর্মসূচি থেকে সচিবালয় ঘেরাও করা হবে।

ইউনাইটেড পিপলস-আপ বাংলাদেশের প্রধান উদোক্তা ও জুলাই বিপ্লবের অন্যতম সংগঠক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধ জন্য মাঠে নামতে হচ্ছে। এটা লজ্জাজনক। আমরা বেঁচে থাকতে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবে না।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা যখনই তাদের কাছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলি, তারা আমাদের পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গির দোহাই দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘যখন শাপলা চত্বর, পিলখানা এবং জুলাইয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় ছিল?’ তবে সারজিস আলম তার বক্তব্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা উপদেষ্টা কিংবা পশ্চিমা কোনো দেশের নাম উল্লেখ করেননি।

তিনি আরও বলেন, এ জেনারেশনকে (প্রজন্ম) ভয় করুন। যদি এ জেনারেশনের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আবেগ নিয়ে খেলা করেন, তাহলে এ জেনারেশন সব ক্ষমতার বিপক্ষে গিয়ে যে কাউকে টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারে।

জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ ইমাম হাসানের ভাই রবিউল আউয়াল বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কেন আমাদের রাস্তায় দৌঁড়াতে হবে। এখানে একটি প্রহসন চলছে। বাংলাদেশে সংস্কার হবে, নির্বাচন হবে; তবে তার আগে বিচার হওয়া লাগবে। সংস্কারের মূল বিষয় হওয়া উচিত বিচার।

শহিদ সাইমের মা বলেন, ‘যাত্রাবাড়ীতে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়। আমার ছেলের কী দোষ? সে আন্দোলন করতে নেমেছিল। তার হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। ’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

তিনি আরও বলেন, আমার বুকটা শূন্য করে দিয়েছে। আমার সোনার ছেলেটাকে হত্যা করছে। ঈদ গেল, আমি ঈদ করতে পারি নাই। আমাদের বুকে রক্তক্ষরণ হয়। আমার ছেলের হত্যার বিচার পাই নাই। এই স্বৈরাচার হাসিনাকে যেন দেশে এনে ফাঁসি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ যেন আর না আসে। তাদের নিষিদ্ধ চাই। এটাই আমাদের আকুতি। আমাদের যে কষ্ট, আমার ছেলে নাই। কখন আমার ছেলের বিচার পাব?

শহিদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের মা শাহিনা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে আশুলিয়ায় ভ্যানের ওপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ও তখন জীবিত ছিল। আমি যখন ওর লাশ পাই, ওর পায়ে মাংস ছিল না। আমার সন্তান মানুষ করতে কি কষ্ট হয়নি? তাকে এভাবে হত্যা করা হলো?

শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশে গণহত্যায় শহীদ আল আমিনের ভাই শফিকুল ইসলাম বলেন, এ দেশে এখন যারা ক্ষমতায় আছে এবং যারা ক্ষমতায় আসবেন এসব আমরা কিছুই বুঝিনা। আমরা শুধু একটাই বুঝি সব শহীদ পরিবার বিচার না পাওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচন হবে না।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এদের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে। নইলে কিন্তু আমি ছাড়ব না। এক সন্তান মারা গেছে। দেশে আমার শত শত সন্তান আছে, তারা ছাড়বে না।

Inkilab-michil-(1)-680bb5cc28a0b

২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত মেজর তানভীর হায়দার নূরের স্ত্রী তাসনূভা মাহা বলেন, আজও আমার স্বামীকে পাওয়া যায়নি। একটা লাশ দাফন হয়েছে, সেটি আমার স্বামীর নয়। সেদিন আমার রুমের বাইরে তিনজন হিন্দিভাষী ছিল। আমার সন্তানদের কাপড় খুলে চেক করেছিল ছেলে নাকি মেয়ে। তিনি বলেন, জুলাই আন্দোলনে এত মায়ের বুক খালি হলো। আপনারা বিচার না করতে পারলে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।

শহিদ সোহেল রানার ভাই বলেন, যে দল আমার ভাইয়ের মতো দুই হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, আপনারা তাদের ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন! আমার ভাইকে রায়েরবাজারে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। কোনটা আমার ভাইয়ের কবর তা পর্যন্ত জানি না। অন্তর্বর্তী সরকার কেন ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে লাশ শনাক্তের উদ্যোগ নেয়নি?

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নুরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল ইসলাম হান্নান বলেন, আমরা আজকে সবাই একত্রিত করেছি একটি দাবিতে। আমাদের দাবিতে হচ্ছে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ যেন আর কখনো রাজনীতি করতে না পারে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজ দেশের ছেলেদের মেরে ফেলতে পারে যে দল, সেই দলকে আমরা এই দেশে চাই না।

এ সময় ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষ থেকে আগামী ১০০ দিনের মধ্যে জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার শুরু এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ, শাপলা গণহত্যার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও জাতিসংঘের সহায়তায় শহিদদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশ ও বিচার নিশ্চিত করা, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ এবং সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি ইশতেহারে আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ বিচারের বিষয়ে স্পষ্ট ধারা উল্লেখ করার দাবি জানানো হয়।