# ডিএনএ টেস্টে ৫ লাশের পরিচয় শনাক্ত
# এখনো নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থী ও দুই অভিভাবক
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে মর্মান্তিক প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান দুর্ঘটনার চারদিন পরও নিখোঁজ সন্তানকে খুঁজছেন বাবা-মা। দুর্ঘটনার পর থেকে শত শত শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক স্কুল গেটের সামনে এসে ভিড় করেন। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা না শুনে কেউ কেউ স্কুলের ভেতরে ঢুকে প্রিয় সন্তানকে না পেয়ে পাচ্ছেন স্কুল ব্যাগ- ও পুড়ে যাওয়া জুতা। সেরকমই একজন অভিভাবক নিখোঁজ মেয়ে মরিয়ম উম্মে আফিয়াকে খুঁজতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে আসেন তার মা তামিমা উম্মে, মামা ও স্বজনরা। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে মেয়েটির মাকে স্কুলের ভেতরে যেতে দেখা যায়। যদিও মাইলস্টোন স্কুল অ্যাড কলেজের ফটকে তালা। শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ক্যাম্পাসে ঢুকতে মানা। কিন্তু সন্তানহারা মা কী সে বাধা মানে। তার হাউমাউ করে কান্না ও বিলাপে স্কুলের ফটক খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ।
পরক্ষণে দৌড়ে যান বিমান বিধ্বস্ত হওয়া ভবনের সামনে। সন্তান মরিয়ম উম্মে আফিয়ার খোঁজ পেলেন না। পরে মেয়ের পোড়া ব্যাগ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ক্যাম্পাস থেকে বের হন মা তামিমা উম্মে। মরিয়ম উম্মে স্কুলটির তৃতীয় শ্রেণির আকাশ শাখায় পড়তো। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না পরিবার। তার খোঁজেই দুপুর ১২টার দিকে স্কুল প্রাঙ্গণে যান মরিয়মের মা, মামা ও স্বজনরা। এর মধ্যে স্বজনদের একজনের হাতে পোড়া ব্যাগ ছিল। মরিয়ম উম্মে আফিয়ার মামা সাব্বির সাংবাদিকদের জানান, তাদের বাসা চন্ডালভোগ এলাকায়। কথা বলার মতো অবস্থা আমাদের নেই। আমার বোন খুবই অসুস্থ। সবাই দোয়া করবেন। এর আগে বেলা ১১টার দিকে স্কুলের ফটকে এসে কথা বলেন স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এস কে সোলায়মান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পরিচয়পত্র দেখালে ও নিখোঁজ স্বজনের খোঁজ করলে তাদের ভেতরে যেতে দেওয়া হবে। স্কুলের ৫ নম্বর ভবনের নিচতলায় হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে। সেখান থেকে তাদের তথ্য দেওয়া হবে। সেখানে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে।
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি দিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে গণমাধ্যমে এ বিবৃতি পাঠানো হয়। বিবৃতির তথ্যমতে, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৮ জন শিক্ষার্থী, দুজন শিক্ষক ও দুজন অভিভাবকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। এছাড়া তিনজন শিক্ষার্থী ও দুজন অভিভাবক এখনো নিখোঁজ বলে জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২১ জুলাই দুপুর ১টা ১২ মিনিট থেকে ১টা ১৪ মিনিটের মধ্যে রাজধানীর দিয়াবাড়ি এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয় এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান। এতে গুরুতর আহত হয়েছেন ৫১ জন, যাদের মধ্যে শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪০ জন। বাকিদের মধ্যে সাতজন শিক্ষক, একজন অভিভাবক, একজন আয়া ও একজন পিয়ন। এখনো নিখোঁজ তিনজন শিক্ষার্থী ও দুজন অভিভাবক। মাইলস্টোন কর্তৃপক্ষ জানায়, ২২ জুলাই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহত ও আহতদের পরিবারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, গণমাধ্যম ও দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, শিক্ষার্থী ও সন্তান হারানোর এ চরম শোকসন্তপ্ত অবস্থায় যারা আমাদের পাশে ছিলেন, তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা সবার দোয়া ও সহমর্মিতা কামনা করছি।
তবে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)-এর সর্বশেষ তথ্যমতে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ জনে। এ ছাড়া এখনো ১৬৫ জন আহত ব্যক্তি চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যে জানানো হয়েছে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং সেখানে বর্তমানে ৪৫ জন দগ্ধ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। সিএমএইচ-এ মৃত্যু হয়েছে আরও ৯ জনের, যেখানে ১৫ জন এখনও ভর্তি আছেন। প্রেস উইং অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিমান দুর্ঘটনায় মোট ২৯ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার ৯টি হাসপাতালে দগ্ধ অবস্থায় আরও ৫৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
অন্যদিকে উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া সেনাবাহিনীর ৪৩ রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নের কমান্ডার মেজর মেহেদী হাসান সেেিদনর ঘটনা সম্পর্কে জানান, বিমান বিধ্বস্তের পর উদ্ধারকাজে গিয়ে প্রথমেই দুটি লাশ দেখতে পায় সেনাবাহিনী। মেজর মেহেদী হাসান বলেন, আমরা এখানে (মাইলস্টোন স্কুল) দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরে প্রথম রেসপন্ডিং টিম হিসেবে স্কুলে প্রবেশ করি। প্রবেশ করে প্রথমেই দুটি লাশ দেখতে পাই, তার মধ্যে সম্ভবত একজন মা এবং তার ছেলের লাশ ছিল। ঘটনাস্থলে এসে আগুনের ভয়াবহতা কেমন দেখলেন, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, এখানে এয়ারক্রাফটটা যে জায়গায় ক্রাশ করেছিল, সেখানে আগুনের প্রজ্বলনটা ছিল। তার সামনে দুটি লাশ পড়ে ছিল, স্পটে এসে এটাই প্রথম দেখতে পাই। স্কুলের যে কক্ষে আগুন লেগেছিল, তার সামনেই দুটি লাশ পড়ে ছিল, এটাই আমাদের প্রথম দৃশ্য এই স্পটে এসে, ওটা দেখার পরই আমরা আমাদের উদ্ধার কার্যক্রমটা শুরু করি। দুর্ঘটনার কত সময় পর সেনবাহিনীর সদস্য উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়, এমন প্রশ্নের জবাবে মেজর মেহেদী হাসান বলেন, আমরা এখানে আনুমানিক দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে পৌঁছাই। যেহেতু আমাদের ক্যাম্পের অবস্থান ১০০ থেকে ১৫০ গজের মধ্যে, সেহেতু আমাদের আসতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মেহেদী হাসান বলেন, উদ্ধার কার্যক্রম শেষ করার পর মোট আমাদের (সেনাবাহিনী) ২৫ জনের মতো সৈনিক অসুস্থ হয়েছিল, কিন্তু ক্রিটিক্যাল পর্যায়ে কেউ নেই। বর্তমানে ১১ জন সৈনিক ঢাকার সিএমএইচে (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে ভিন্নতার বিষয়ে ইঙ্গিত করে মেজর মেহেদী হাসান বলেন, আমরা এখানে সবাই কাজ করছিলাম, একেকজনের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। এখন সঠিক সংখ্যাটা স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং যারা হাসপাতালে আছেন, তাদের সমন্বয়ে আসলে আপনারা (সাংবাদিক) পেয়ে যাবেন। আমরা উদ্ধার কার্যক্রমকেই মেইন ফোকাসে রেখে কাজ করেছি, কতজনকে নিয়ে যেতে পেরেছি, আসলে ওই সময় আমাদের ওইটা কাজ করে নাই। আমরা যাদের সামনে পেয়েছি, তাদের একটা নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে কাজ করেছি।
৫ লাশের পরিচয় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ৫ লাশের পরিচয় ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এসব লাশের বিপরীতে ১১ জন দাবিদারের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিমান দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ ৫ জনের পরিচয় শনাক্ত করেছে সিআইডির ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব। এরা হলো-ওকিয়া ফেরদৌস নিধি, লামিয়া আক্তার সোনিয়া, আফসানা আক্তার প্রিয়া, রাইসা মনি ও মারিয়াম উম্মে আফিয়া। সিআইডি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিমান বিধ্বস্তের কারণে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় গত ২২ জুলাই সিআইডির ডিএনএ ল্যাবের সদস্যরা ঢাকা সিএমএইচ-এ রক্ষিত অশনাক্ত মরদেহ ও দেহাংশ থেকে মোট ১১টি ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেন। এই নমুনাগুলো বিশ্লেষণ করে মোট ৫ নারীর ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়। নমুনা থেকে প্রস্তুত করা প্রোফাইল ও ঘটনার পর থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৫টি পরিবারের মোট ১১ জন সদস্যের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে ৫টি লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। সিআইডি আরও জানায়, গৃহীত ১টি নমুনা থেকে একজন নারীর ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, যার দাবিদার মো. ফারুক হোসেন ও সালমা আক্তার দম্পতির কন্যাসন্তান (ওকিয়া ফেরদৌস নিধি) প্রমাণিত হয়। গৃহীত ৬টি নমুনা থেকে একজন নারীর ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, যার দাবিদার মো. বাবুল ও মাজেদা দম্পতির কন্যাসন্তান (লামিয়া আক্তার সোনিয়া) প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, গৃহীত ২টি নমুনা থেকে একজন নারীর ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, যার দাবিদার মো. আব্বাস উদ্দিন ও মিনু আক্তার দম্পতির কন্যাসন্তান (আফসানা আক্তার প্রিয়া) প্রমাণিত হয়। গৃহীত আরও একটি নমুনা থেকে একজন নারীর ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, যার দাবিদার মো. শাহাবুল শেখ ও মিম দম্পতির কন্যাসন্তান (রাইসা মনি) প্রমাণিত হয়। এছাড়া সর্বশেষ গৃহীত ১টি নমুনা থেকে একজন নারীর ডিএনএ প্রোফাইল পাওয়া যায়, যার দাবিদার আব্দুল কাদির ও উম্মে তামিমা আক্তার দম্পতির কন্যাসন্তান (মারিয়াম উম্মে আফিয়া) প্রমাণিত হয়। এর আগে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) শম্পা ইয়াসমিন জানান, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে থাকা পাঁচ লাশ বা দেহাবশেষ থেকে ১১টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর বিপরীতে সিআইডিতে এসে এখন পর্যন্ত ১১ জন দাবিদার তাদের রক্তের নমুনা দিয়ে গেছেন। এদের মধ্যে এক পরিবারের একাধিক ব্যক্তিও রয়েছেন।
আরও দুই জনের মৃত্যু: বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে দগ্ধ আরেক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় শিশু মাহিয়া তাসনিম ওরফে মায়া (১৫)। সে পরিবারের সঙ্গে উত্তরা ১৮ নম্বরে থাকত। বাবা মৃত আলী বিশ্বাস। তাঁদের গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা। মাহিয়া মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। এর আগে বেলা ১টা ৫২ মিনিটে মারা যায় শিশু মাহতাব রহমান ভূঁইয়া (১৪)। এ নিয়ে এ ঘটনায় বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ১৩ জনের মৃত্যু হলো। মাহিয়ার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক শাওন বিন রহমান বলেন, মাহিয়ার শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ৪২ জন চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ছয়জনকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।