গণভোটের কথা বলে অনেকে নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায়--- আমীর খসরু
গণভোট নিয়ে বিএনপির আহ্বানেও বসতে প্রস্তুত জামায়াত -- ড. হামিদ আজাদ
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, সরকার ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ নিয়ে কোন দ্বিধা-সংকোচ থাকা উচিত নয়। তিনি বলেন, শাসনব্যবস্থা ও জুলাই সনদ নিয়ে বিতর্ক সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। সারাবিশ্বে সংবিধান সংক্রান্ত বিতর্কে সময় লাগে, কখনও তা দশক ধরেও চলে। রাতারাতি কোনো সমাধান চাপিয়ে দেওয়া যায় না। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ট্রেস কনসালট্যান্সি নামে এক সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত প্রযুক্তিনির্ভর নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে সংলাপে তিনি এসব কথা জানান।
শফিকুল আলম বলেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনিশ্চয়তা দূর করতে ম্যান্ডেট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। তিনি বলেন, আমরা এখন একটি ফ্র্যাকচারড পলিটিক্যাল সিচুয়েশন দেখছি। এখন ডান, বাম ও মধ্যপন্থী সব পক্ষের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক সমাধান প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শক্ত ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিষয়ে এখন সবার একটি স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া জরুরি। তিনি এখনও জুলাই গণঅভুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে প্রেস সচিব বলেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমি মনে করি, এই বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অস্তিত্বের হুমকি। একজন মানুষকে যখন ‘সন্ত্রাসী’ বলা হয়, তখন আসলে তাকে হত্যাযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি কি ১৮ কোটি মানুষকে শত্রু ঘোষণা করে আবার ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছেন ?
সাংবাদিক এনায়েতুল্লাহ খানের বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, এনায়েতুল্লাহ খান একসময় লিখেছিলেনÑ ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব ৬ কোটি ৫০ লাখ মানুষকে কোলাবরেটরস বা রাজাকার বানিয়েছিলেন, আর এখন তার মেয়ে ১৮ কোটি মানুষকে সন্ত্রাসী বলছেন! এটা কল্পনাতীত।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এই সরকার সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে। সেই সংবিধানে গণভোটের কিছু নেই। যদি গণভোট করতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুসারে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে এসে সংসদে পাস করার পরে সেই বিষয়গুলো গণভোটে যেতে পারে। এসব করে অনেকে নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চায় বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু।
সংলাপে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদকে পাশে রেখে আমীর খসরু বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো অবসেসড হয়ে গেছে। কিছু কিছু রাজনীতিবিদের মধ্যে এ ধরনের মনমানসিকতা তৈরি হয়েছে। আমীর খসরু আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে যে যতটুকু ঐকমত্য হয়েছে, তার বাইরে গিয়ে আবার নতুন ইস্যু সৃষ্টি করলে কিন্তু ঐকমত্যের শ্রদ্ধা দেখানো হচ্ছে না। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও ঐকমত্য হতে হবে।
সংলাপে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচ হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে গণভোট নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য একটি এসিড টেস্ট। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হলে ভোটারের উপস্থিতি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জনগণের অভিপ্রায় এখন একটি সুন্দর ও পরিবর্তিত বাংলাদেশ গড়া। সেই লক্ষ্যেই সংস্কারের মধ্যদিয়ে রাজনীতি এগিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াত কোনো প্রেশার গ্রুপ নয়, বরং জনগণের মতামত ও প্রত্যাশা প্রতিফলিত করতে রাজপথে রয়েছে। আমরা মতভিন্নতা মেনে নিতে পারি, কিন্তু মতবিরোধ চাই না। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হবে এমন প্রত্যাশা নিয়ে আমরা এগোচ্ছি।
বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক প্রসঙ্গে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জামায়াতের আহ্বানে বিএনপি বসতে রাজি হয়নি। আমরাও চাই না রাজনীতি আবার ফ্যাসিবাদী কালচারে ফিরে যাক। বিএনপি আহ্বান করলে আমরা আলোচনায় যেতে প্রস্তুত। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, কিছু নোট অব ডিসেন্টসহ সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সনদের বাইরের বিষয়। ফলে সেখানে নোট অব ডিসেন্ট নেই। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া পেশ করার পরই মতভিন্নতা তৈরি হয়েছে। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, গণভোটের সময় নিয়ে প্যাঁচ লাগিয়েছে কমিশন। নির্বাচনের দিন গণভোট হলে নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় নির্বাচনে মূল ফোকাস থাকে বিজয়ী হওয়া। অনেক সময় ভোটগ্রহণ স্থগিত হতে পারে, সে ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় পড়বে সনদ।
হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, আমরা বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছিলাম। তারা বলেছেন, আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন না। আমরা যেকোনো সময় আলোচনায় বসতে রাজি আছি। প্রয়োজনে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে আলোচনায় বসতে উদ্বুদ্ধ করব। তিনি বলেন, জুলাই বিপ্লবের আকাক্সক্ষা জামায়াত চাপিয়ে দিচ্ছে না। এটা সরকারের প্রতিশ্রুতি। জুলাই সনদ আর সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আলাদা। বাস্তবায়নের ওপর কোনও সাক্ষর হয়নি। সরকার সেই উদ্যোগ নেয়ার কারণেই বিরোধ তৈরি হয়েছে। জামায়াতের এই নেতা বলেন, ডেমোক্রেসিতে (গণতন্ত্র) আলোচনা এবং রাজপথে ভয়েস রেইজ করা (আওয়াজ তোলা)Ñএই দুটোই চলে। আমরা তো ভায়োলেন্স (সহিংসতা) করছি না।
জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে মানুষের ফোকাস থাকে দল, প্রার্থীকেন্দ্রিক। আমাদের দেশে ভোটকেন্দ্র দখল হয়। দুটো ভোট দিতে গেলে টাইম ম্যানেজমেন্ট হবে না, ভোট কাস্টিং কম হবে। পরে আবার বলবে, জনগণ জুলাই চার্টারের পক্ষে রায় দেয় নাই। হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এখনো আছে। এখন জনগণের আস্থা নেই। আগে গণভোট হলে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা তৈরি হবে। এতে নির্বাচনটা ভালো হবে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক শাহাব এনাম খানের সঞ্চালনায় এতে আরও বক্তব্য দেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, ডাকসুর ভিপি সাদিক কায়েম প্রমুখ। আয়োজনটির সভাপতিত্ব করেন ট্রেস কনসালট্যান্সির প্রধান নির্বাহী ফুয়াদ এম খালিদ হোসেন।