টেলিযোগাযোগ খাতের একটি প্রকল্প নিয়ে দুদকের তদন্ত ‘থামিয়ে দিতে’ প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব যে চিঠি দিয়েছেন তা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি ছড়ানোর অবকাশ নেই’ বলে দাবি করেছেন সংস্থার চেয়ারম্যান। দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের দাবি, তাকে লিখিত বিশেষ সহকারীর চিঠিতে তিনি বরং বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ খাতের আধুনিকায়নের আহ্বানে সহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যানের তরফে এই বিবৃতি সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন সংস্থার মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন।

দুদককে দেওয়া চিঠির বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে ব্যাখ্যা দেন। পরের দিন গতকাল মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের তরফে বক্তব্য এল। এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে দুদক মহাপরিচালক আক্তার বলেন, আমি খুব স্পষ্টভাবে বলেছি যে আপনাদের এই বিষয়ে গতকাল ব্রিফিং করা হয়েছিল। সুতরাং সেই বিষয়টারই প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যানের যে বক্তব্য, সেটা আপনাদেরকে জানিয়েছি। এ নিয়ে আরও জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। এই কারণে যে, আমাদের কাছে কিন্তু এই সংক্রান্ত একটা অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। ফলে আমরা যদি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করি তাহলে সেই ক্ষেত্রে বিষয়টা বিতর্কিত হতে পারে এবং আমি যেভাবেই কথা বলি না কেন, দেখা যাবে যে সেটা অনুসন্ধানকে প্রভাবিত করতে পারে। সেই কারণে আমার মনে হয়, এ বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভালো।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখপাত্র হিসেবে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চান না, কারণ মন্তব্য করলে তা তদন্ত প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী তৈয়্যব যখন মন্তব্য করেন, সেটিও কি প্রভাবিত করে না? জবাবে আক্তার বলেন, আমরা কিন্তু বলিনি সেটা প্রভাবিত করে। আমরা শুধু বলেছি, চেয়ারম্যান বলেছেন যে সেটাতে যেন বিভ্রান্তি না ছড়ায়, সেজন্য তিনি তার অবস্থানটা এখানে পরিষ্কার করেছেন।

টেলিযোগাযোগ খাতের একটি প্রকল্প নিয়ে ‘দুদককে থামিয়ে দিতে বিশেষ সহকারীর চিঠি, দেড়শ কোটির প্রকল্পে ব্যয় ৩২৬ কোটি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন রোববার প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা। পরদিন সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী তৈয়্যব এ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত ‘থামিয়ে দিতে’ চিঠি দেওয়ার বিষয়টি সত্য নয় বলে দাবি করেন। তার ভাষ্য, ‘মূলত সেই ডিও লেটার (আধা সরকারি পত্র) দিয়ে দুদকের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করা হয়েছে। লিখিত বক্তব্যে তিনি টেলিযোগাযোগ লাইসেন্সকে কেন্দ্র করে ‘স্বার্থান্বেষী মাফিয়াদের রোষানলে পড়েছেন’ বলে অভিযোগ করেন। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী তার অবস্থান তুলে ধরে দুদককে চিঠি দেওয়ার কারণও তুলে ধরেন।

‘বিটিসিএল’র ফাইভজি রেডিনেস’ শীর্ষক একটি প্রকল্প নিয়ে অভিযোগের পর অনুসন্ধানে নামে দুদক। ওই অভিযোগে বলা হয়, দরপত্রের শর্তানুযায়ী দরদাতাদের মূল্যায়ন না করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে শুধু প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের ভিত্তিতে তিনজন দরদাতাকেই কারিগরিভাবে ‘ রেসপনসিভ’ ঘোষণা করাসহ ‘নন রেসপনসিভ’ দরদাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার ৫ গুণ বেশি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি কিনে বড় অঙ্কের রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতি করা হচ্ছে। এ অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে দুদক সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় ‘পিপিএ ও পিপিআর লঙ্ঘনের প্রমাণ মেলার’ তথ্য দিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে গত ১৮ জুন চিঠি দেয়। এতে প্রকল্পের ‘অর্থছাড় বন্ধ রাখার’ পরামর্শ দেওয়া হয়। সেই অর্থছাড়ের প্রক্রিয়া চালিয়ে নিতেই প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী তৈয়্যব গত ২২ জুন দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি লেখেন। তিনি বলেন, বিটিসিএল যেই ফাইবার নেটওয়ার্ক বর্ধিতকরণের যে প্রকল্প বিগত স্বৈরাচার সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছিল, যার দরপত্র বিগত সময়ে হয়েছে, দরপত্র প্রক্রিয়া প্রভাবিত করার কাজগুলো বিগত সরকারের আমলে হয়েছে এবং সেখানে যে একটা ঋণপত্র করা হয়েছিল, আমি এবং নাহিদ ইসলাম (সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা) দায়িত্ব নেওয়ার আগে সেই ঋণপত্রে ২৯০ কোটি টাকা অফেরতযোগ্য এলসিও পরিশোধ করা হয়ে গেছে-এই সবকিছু আমলে নিয়ে আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয়ের সাথে কথা বলি। আমি নিজে উনার অফিসে গিয়েছি। আমি বলেছি যে স্যার, যেহেতু ২৯০ কোটি টাকা চলে গেছে এবং যেহেতু এটা সর্বনি¤œ দরদাতা এবং দরদাতা নিয়ে যে অপতথ্যটা এসেছিল, সেটা বুয়েট যেহেতু ক্ল্যারিফাই করেছে, আমরা একটা কমিটি করে দেব। তিনি বলেন, এই কমিটির মাধ্যমে যে যন্ত্রপাতিগুলো তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে (এটা ওএসআর ৯৮০০ এ২ এবং এম২) বিটিসিএলের যে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বী, বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড খাতে ইতিমধ্যেই এটা স্থাপিত হচ্ছে এবং ব্যাপক আকারে স্থাপিত হচ্ছে। কিছু বিশেষ কোম্পানি বিটিসিএলকে এই মার্কেট থেকে আউট করে দিতে চায়। তো আমরা এই বক্তব্য যখন তুলে ধরেছি, তখন বলা হয়েছে, ঠিক আছে, আমাদেরকে বিস্তারিত জানানো হোক। সেই রেফারেন্সে আমি দুদক চেয়ারম্যানকে একটা চিঠি লিখি। এই চিঠিতে আমি মূলত আমার যুক্তিগুলো তুলে ধরি যে যেহেতু টাকাটা চলে গেছে, যেহেতু আমাদের বিটিসিএলের ক্যাপাসিটি সম্প্রসারণ দরকার-আপনারা জানেন যে বর্তমানে যে ক্যাপাসিটি আছে, এটা জেলা পর্যায়ে মাত্র এক জিবিপিএস, এটা দিয়ে আসলে বেটার কোয়ালিটি ইন্টারনেট সেবা দান অসম্ভব। এখন এই মুহূর্তে বিটিসিএল যদি এই নেটওয়ার্ক আপগ্রেড না করে, তাহলে খুব দ্রুতই সে মার্কেট আউট হয়ে যেতে পারে।

দাবির স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তৈয়্যব বলেন, এখন যেহেতু তার প্রতিদ্বন্দ্বীগুলো নেটওয়ার্ক আপগ্রেড করছে এবং বিটিসিএল বিভিন্ন ঝামেলার কারণে-যেগুলো সাবেক সরকারের আমলে দুর্নীতির অভিযোগ এবং বিভিন্ন কারণে, এই কাজটা বন্ধ হয়ে আছে, সেজন্য বিটিসিএলের যে ফাইবার নেটওয়ার্ক আছে, এটা এক্সপ্যান্ড করা যাচ্ছে না। তার দাবি, এটাকে অপব্যাখ্যা করে তাকে ব্যক্তিগতভাবে, মন্ত্রণালয়কে এবং সরকারের চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি এবং আমার মন্ত্রণালয়ের বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্তরা কোনো ধরনের কোনো দুর্নীতিতে জড়িত নই এবং এখানে যত ধরনের কাজ হয়েছে, প্রত্যেকটা কাজ আগের সরকারের আমলে হয়েছে। আমরা শুধুমাত্র কিছু চিঠি আদান-প্রদান করে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি এবং মতামত ব্যক্ত করে চিঠির শেষ লাইনে দুদক চেয়ারম্যানের আন্তরিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছি। এর বাইরে আমরা কোনো নির্দেশ দেইনি।