নাছির উদ্দিন শোয়েব: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের প্রায় ২৫০০ নতুন এমআইএস (MIS) ও গেজেট প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতা ও গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দফতরে দফতরে ঘুরে ১৬ মাস পার হলেও এখনও তাদের এমআইএস অন্তর্ভুক্তি ও গেজেট প্রকাশের কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানিয়েছেন শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধারা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ-এক মন্ত্রনালয় অন্য মন্ত্রনালয়ের ওপর দায় চাপিয়ে সময় ক্ষেপন করছে। তারা বলছেন-দ্রুত নথিভুক্ত না করা হলে তারা আবারও রাজপথে আন্দোনের নামবেন।
তালিকাভুক্তি না হওয়া জুলাই যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠনের নেতা জানান, গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও আহত জুলাই যোদ্ধাদের ২৫০০ নতুন এমআইএস ও গেজেট প্রকাশে সরকারের গড়িমসিতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, এমআইএস সফটওয়্যার বন্ধ করে রাখার কারণে এসব যোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। তালিকাভুক্তির দাবি নিয়ে গত কয়েক মাসে একাধিকবার সচিবালয়সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেছন। রাজধানীর শাহবাগ, সচিবালয়ের সামনেসহ কয়েকটি স্থানে বিক্ষোভ, মানববন্ধন করেছেন। এরপ প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে সরকারের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ ও একাধিক বৈঠক হয়েছে। তারপরও সরকারের আশ্বাস পর্যন্তই শেষ, কিন্তু বাস্তবে কোনো অগ্রগতি নেই। গত ২৮ মে শাহবাগ থেকে সচিবালয় অভিমুখে পদযাত্রা করে প্রতিনিধি দল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা এবং সচিবদের সাথে বৈঠক করে। এসময়ও আশ্বাস দেয়া হয় দ্রুত যাচাই-বাছাই করে এমআইএস সম্পন্ন করা হবে। এরপর ২২ জুন দ্বিতীয় দফা মিটিং করা হয়। ৩১ জুলাই মানববন্ধন করার পর আবারও সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে দ্রুত তালিকাভুক্ত করার আশ্বাস দেয়া হয়। এরপর ১২ আগস্ট শাহবাগ থেকে সচিবালয় পদ যাত্রা করলেও শিক্ষা ভবনের সামনে পুলিশ বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর প্রতিনিধি দলেল কাছ থেকে এক মাস সময় নেয় এবং আশ্বাস দেয় দ্রুত তালিকাভুক্তি করার। গত ৮ অক্টোবর মানববন্ধন কর্মসূচি করে সচিবালয়ে দুর্যোগ, ত্রাণ ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক উপদেষ্টা মো: ফারুকী আজমের (বীর প্রতীক) সঙ্গে বৈঠক হয়। তিনি গণভ্যুত্থান অধিদফতরের ডিজিকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করতে নির্দেশ দেন। সচিবালয়ে চার উপদেষ্টা-স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও মুক্তিযুদ্ধ এবং একাধিক সচিবের উপস্থিতিতে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে এমআইএস সম্পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সময়সীমা পার হলেও কাজ শেষ হয়নি। এরপর গত ১৬ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত জাহানের সাথে বৈঠক। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, মুক্তিযুদ্ধ উপদেষ্টা ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা বরাবর চিঠি প্রেরণ। তবুও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি।
জুলাই গণ অভ্যুত্থাণ অধিদফতর বলছে, তারা তালিকাভুক্তির জন্য নতুন করে তদন্তের উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট ৪৪ টি জেলায় ২১৬৯ টি ফাইল পাঠিয়েছেন। সেগুলো হাতে আসলে এমআইএস ও গেজেট প্রকাশ করা হবে। তবে তা কবে নাগাদ হবে তা স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। ভুয়া নাম ঠেকাতে জুলাই শহীদ ও আহতদের তালিকা নতুন করে যাচাই করতে জেলা প্রশাসকদের চিঠি পাঠানো হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ না হয়েও এই তালিকায় যাতে নাম অন্তর্ভুক্ত না হতে পারে, তা নিশ্চিত করতেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর এসব তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ‘জুলাই যোদ্ধাদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত জেলা কমিটি’র কাছে পাঠিয়েছে। এই কমিটির সভাপতি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক। অন্যদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনও রয়েছেন। এরআগেও একবার জেলাগুলো থেকে একবার এই তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রনারয়ে পাঠিয়েছে। তখন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, এসপি ও সিভিল সার্জন নিয়ে গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাই করেই তালিকা পাঠিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জুলাই গণঅভ্যুত্থান শাখার দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, আমরা জেলাগুলোকে ফাইল ও চিঠি দিয়েছি। তারা বিষয়টি আবার যাচাই-বাছাই করবেন। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ না হয়েও ৫২ জনের নাম তালিকায় আসায় একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তবে ৫২ জনকে অনুদান দেওয়া হয়নি। তাদের মধ্যে ২১ জনকে প্রথম পর্যায়ের অনুদান দেওয়া হয়েছিল। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ৭৮২ জনের পরিবারকে প্রথম পর্যায়ে অনুদান দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৮৪ জনকে এই সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কারও বিষয়ে কোনো ইস্যু আছে কিনা, আমরা সেটা জানাতে বলেছি। জেলাগুলোর যাচাই-বাছাই কমিটি সেটা আমাদের জানাবে। সংশ্লিষ্ট জেলার জুলাই যোদ্ধা ও শহীদরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে আহত বা শহীদ হয়েছেন কি না, তা যাচাই করতে বলা হয়েছে চিঠিতে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় জুলাই শহীদ ও জুলাই যোদ্ধাদের গেজেট প্রকাশ এবং ভাতাসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
সরকারি গেজেটে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৬ এবং আহত ১৩ হাজার ৮০০। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকেও বিভিন্নজনের নাম আহত ব্যক্তিদের তালিকা থেকে বাদ দিতে জুলাই গণ–অভ্যুত্থান অধিদপ্তরকে অনুরোধ করেছে। সম্প্রতি জুলাই ফাউন্ডেশনে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে ‘জুলাই যোদ্ধা’র পক্ষ থেকে মামলাও হয়। তাঁর দাবি, তাঁকে ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ আখ্যায়িত করে আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয় গত মার্চ মাসে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নতুন করে আহত ব্যক্তিদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে ৪৪ জেলা থেকে আবেদন জমা পড়েছে ২ হাজার ১৬৯টি। এর সাথে ঢাকা জেলার গুলো যোগ করলে এ সংখ্যা হবে আড়াই হাজার। এখন পর্যন্ত ১১টি জেলা থেকে পুনরায় যাচাইয়ের পর ফাইল পাঠানো হয়েছে। বাহি জেলা থেকে পুনরায় যাচাইয়ের নথি আসেনি। সবগুলো আসলে একসাথে এমআইএস করা হবে।
কয়েকজন জুলাই যোদ্ধা অভিযোগ করেন, রি-ভেরিফাই করতে জেলা প্রশাসন অবহেলা করছে। এর আগে সব জেলা থেকেই ৫ ধাপের যাচাই প্রক্রিয়া শেষে তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এরপর আবার রি-ভেরিফাইয়ের জন্য জেলা প্রশাসনে পাঠানো হয় এবং ১০ কর্মদিবসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু বহু জেলার ডিসি (জেলা প্রশাসক) এখনও কাজ শেষ করেননি, যা নিয়ে শহীদ পরিবার ও যোদ্ধার মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। শহীদ পরিবার একমাত্র উপার্জনকারী হারিয়ে চরম কষ্টে দিন যাপন করছে। আহত জুলাই যোদ্ধারা এমআইএস বঞ্চনার কারণে চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত, অনেকে অর্থাভাবে চিকিৎসা নিতে পারছেন না। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এদিকে, ৬৪ জেলার শহীদ পরিবার ও আহত জুলাই যোদ্ধারা জানিয়েছেন, যাদের রক্তের ওপর ভর করে সরকার গঠিত হলো, তাদের প্রতি এমন অবহেলা আমরা মেনে নেব না। টালবাহানা নয়-দ্রুত এমআইএস গেজেট প্রকাশ করতে হবে। তারা চূড়ান্ত আন্দোলনের হুমকি দিয়ে জানিয়েছেন, সরকারের উদাসীন আচরণ অব্যাহত থাকলে তারা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবে।
এব্যাপারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদফতরের মহাপরিচালক মোঃ মশিউর রহমান দৈনিক সংগ্রামকে জানান, এরআগে বেশ কয়েকজন ভুয়া শহীদ এবং ভুয়া যোদ্ধার সন্ধান মিলছে। শুরুর দিকে জেলা থেকে যথাযথ যাচাই বাছাই হয়নি, এ কারণে দ্বিতীয় দফায় নিখুঁতভাবে জুলাই যোদ্ধাদের কাজটি সম্পন্ন করতে চাই। তিনি বলেন, একটু দেরি হলেও এবারের তালিকাটি নির্বাচনের আগেই সম্পন্ন করা হবে। তিনি জানান, জেলা থেকে যাচাই বাছাই কমিটি ফাইল পাঠাতে বিলম্ব করছে। তাদেরকে একটি সময়-সীমা বেধে দেয়া হলেও যথাসময়ে পাঠাতে পারেনি। তারপরও কেউ যাতে বাদ না পড়ে সে বিষয়ে আমরা শতর্ক আছি। এখনো যেসব জেলা থেকে ফাইল আমাদের দফতরে আসা বাকি আছে সেসব জেলা থেকে ফাইল আসলে চূড়ান্তভাবে এমআইএস নথিভুক্ত এবং গেজেট প্রকাশ করার কাজ শুরু হবে। জুলাই যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কাজটি ত্রুটিমুক্ত করতে বিলম্ব হচ্ছে।