বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামো উন্নয়নের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয়েছে। ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস এপি মোলার-মেয়ার্স্ক গ্রুপের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রাম বন্দরে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তবায়নে ৫৫০ মিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ নিশ্চিত করেছে। এটি দেশের সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং অন্যতম বৃহৎ পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্প।

গতকাল সোমাবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এপিএম টার্মিনালস এবং স্থানীয় অংশীদার কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিসেস লিমিটেডকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে লেটার অব এওয়ার্ড প্রদান এবং প্রকল্প উদ্বোধনের জন্য একটি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। পিপিপি কর্তৃপক্ষ, এপিএম টার্মিনালস এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের শীর্ষ পর্যায়ের অতিথিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

বিশ্বখ্যাত এ.পি. মোলার-মেয়ার্স্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান রবার্ট মেয়ার্স্ক উগলা এবং ডেনমার্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি, মাননীয় লিনা গান্ডলোসে হ্যানসেন এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে বাংলাদেশে আগমন করেন। প্রকল্পটি ৩০ বছরের কনসেশন চুক্তির আওতায় সম্পূর্ণ বেসরকারি মূলধন বিনিয়োগে বাস্তবায়িত হবেÑযেখানে সরকারের জন্য কোনো ঋণের বোঝা থাকবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি নির্মাণ, অর্থায়ন ও পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব বেসরকারি অংশীদারদের ওপর থাকবে।

ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাননীয় লার্স লকে রাসমুসেন ভার্চুয়াল বার্তায় বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মেয়ার্স্ক-এর অংশীদারিত্ব দীর্ঘদিনের এবং আমাদের দুই দেশের মধ্যে দৃঢ় বাণিজ্যিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। বর্তমানে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া সমস্ত কনটেইনারের প্রায় ৩০% পরিচালনা করে মার্স্ক। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালে মেয়ার্স্ক-এপিএম টার্মিনালস-এর এই বিনিয়োগ একটি বাস্তব ও টেকসই অংশীদারিত্বের শক্তিশালী প্রতীক, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি গভীর আস্থার প্রকাশ।

এপিএম টার্মিনালস-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কিথ স্বেন্ডসেন বলেন, এই গ্রিনফিল্ড প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা স্থানীয় ম্যানুফ্যাকচারার, রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের কার্যক্রমে সক্রিয় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারব। পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তি তৈরির মাধ্যমে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস. এম. মোনিরুজ্জামান বলেন, এখনই আমাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। চট্টগ্রাম একটি নদী ও ফিডার বন্দর হওয়ায় লজিস্টিক্স (যানবাহনের) খরচ অনেক বেশি। প্রতিযোগিতামূলক হতে হলে আমাদের এমন অবকাঠামোর প্রয়োজন যা দ্রুত বাজারে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। এই টার্মিনাল সেই লক্ষ্যপূরণে সহায়ক হবে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও জটিলতা চট্টগ্রাম বন্দরের সম্ভাবনার পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে। লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে বড় জাহাজ ভিড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে এবং রপ্তানিকারকদের জন্য বন্দর সেবা আরও নির্ভরযোগ্য হবে। মেয়ার্স্কের মতো অভিজ্ঞ অপারেটরের আগমন আমাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর বাস্তব সমাধানে সহায়তা করবে।

পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আশিক চৌধুরী বলেন, এই প্রকল্প প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে পিপিপি এখন কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। আমরা একটি বিশ্বমানের টার্মিনাল ও পোর্ট পেতে যাচ্ছি, এবং এর জন্য সরকারকে কোনো ঋণ নিতে হয়নি। লালদিয়া টার্মিনাল চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৪৪% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এই ধরনের প্রকল্প আমাদের বিনিয়োগকারীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস উভয়ই তৈরি করে। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন প্রমুখ।