বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন বলেছেন, তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পদে পদে বাধাগ্রস্ত করতে যাওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে দলনিরপেক্ষ নয়, সেই বয়ান চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই সরকারের নিরপেক্ষতার পর্দার পেছনে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা অগণতান্ত্রিক শক্তির পরাজয় ঘটেছে। জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বিনা ভোটে রাষ্ট্রক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার সম্ভাব্য দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ভেস্তে গেছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে মেয়র পদে বসে নগর পরিচালনার পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পরামর্শক্রমে অবৈধ তাপসের (দক্ষিণ সিটির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস) বিরুদ্ধে পাওয়া রায়টি একটি স্থায়ী দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য, আইনের শাসনের চূড়ান্ত বিজয়ের একটি প্রমাণ হিসেবে রাখার জন্য সিদ্ধান্ত (আন্দোলন করার) নেওয়া হয়েছিল।
প্রশাসক হওয়ার প্রস্তাব অপমানজনক : সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ইশরাক হোসেন অভিযোগ করেন, একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া অত্যন্ত আপত্তিকর কিছু কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতা ইশরাক বলেন, ‘আসিফ বলেছেন, ইশরাক হোসেন অত্যন্ত দম্ভ ভরে ও অহংকারের সঙ্গে সরকার কর্তৃক প্রশাসক হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।’ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, একজন বৈধ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদের জন্য এই প্রস্তাব অপমানজনক।
ইশরাক বলেন, ‘আসিফ বলেছে বিএনপির এক নেতার ইন্ধনে ইশরাকের আন্দোলন হয়েছে। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ঢাকার হাজার হাজার ভোটারকে চরম অপমান করা হয়েছে। ঝড়, বৃষ্টি, তীব্র রোদ উপেক্ষা করে দিনের পর দিন শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করে আন্দোলন করা ঢাকার এই জনগোষ্ঠীকে একটি বাক্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে নাগরিক থেকে পশুর মর্যাদায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটার জন্য তাঁকে অবশ্যই নাগরিকদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
ইশরাকের ভাষ্য, আসিফ বলেন, আমাকে তার নির্বাচনী এলাকা কুমিল্লার একটি উপজেলার জনৈক বিএনপি নেতা প্ররোচণা দিয়েছেন। এই আন্দোলনে অর্থ ও লজিস্টিক দিয়েছেন এবং তার কাছে নাকি প্রমাণ আছে। এই প্রমাণ তিনি জাতির সামনে তুলে ধরবেন অন্যথায় তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। এখানেই তিনি থেমে থাকেন নাই। তিনি বলেছেন বিএনপির একটি অংশের সরকারের সাথে বোঝাপড়ার দূরত্ব তৈরি হওয়ার কারণে আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বিএনপির মত ঐতিহ্যবাহী পুরানো বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে হেয় করেছেন এবং একটি অসত্য অভিযোগ তুলেছেন। তিনি নিজেকে বিশাল কোনো মহামানব হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। উনি হয়ত ভুলে গেছেন ওনার জন্মের আগে বিএনপির জন্ম হয়েছে।
আসিফকে কথাবার্তার ‘লাগাম টেনে ধরার’ কথা বলেছেন ইশরাক। কারো প্ররোচনায় বা নিজ সিদ্ধান্তে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিষয়ে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপের চিন্তা ভুলক্রমে করবে না। এটা একটা সতর্কবাণী হিসাবে দিচ্ছি। না পুনরায় আন্দোলন শুরু হলে তা নগরভবনের গ-ি পেরিয়ে রাজপথে গড়াবে।
ইশরাক বলেন, সরকার কোন নির্বাচনকে বৈধতা দেবে না বলে আসিফ মাহমুদ বলেছেন। এটা কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা হবে এবং কবে? এখন পর্যন্ত তারা কোন কোন নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করতে পেরেছে? একটিও না। এর অর্থ এই দাঁড়ায় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক বৈধতা বহাল রাখা গেজেটকে পুরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বৈধতা দিচ্ছে না বা মানছে না। সেটা সরকার কর্তৃক উচ্চ আদালত অবমাননার শামিল নয় কি ? এই একই আদালত বাংলাদেশের সংবিধানের আর্টিকেল ১০৬ এর ধারা অনুযায়ী বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বৈধতা দেয়নি? বরঞ্চ উল্লেখযোগ্য উদাহারণ হিসাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচন ২০২০ আমাদের মামলা ও রায়ের মাধ্যমে তৎকালীন নির্বাচনটির ফলাফল অবৈধভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল সেটিই প্রমাণিত হয় এবং ফলাফল সংশোধনের মাধ্যমে সেটি আর বেশি সুদৃঢ় হয়েছে।
অনেক জায়গায় কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়া ওয়ার্ড সচিব হিসেবে এনসিপি সংশ্লিষ্ট বাক্তিদের ‘নিয়োগ দেওয়া হয়েছে’ বলে অভিযোগ তুলেছেন ইশরাক। এই অভিযোগ সত্য হলে এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে বলেও জানিয়েছেন ইশরাক।
হামলায় ‘উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠরা’ : মঙ্গলবার নগর ভবনে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও মারধরের ঘটনায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াকে দায়ী করছেন ইশরাক হোসেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গতকাল হামলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ হিসেবে সুপরিচিত কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার নেতৃত্বে। এরা কেউ কেউ নিজেদের বিএনপি ঘরানার পরিচয় দিলেও তারা দলের কোনো পদে নেই। তাদের মূল হোতা গতকাল আন্দোলনকারীদের হত্যাচেষ্টা করা গোলাম কিবরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।’
উল্লেখ্য, গোলাম কিবরিয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগে কর্মরত আছেন। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির শীর্ষ তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গোলাম কিবরিয়া ১৯৯৪ সালে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বৃহত্তর সূত্রাপুর থানা ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ছাত্রজীবনে তিনি বিএনপিপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের অন্তত ১০টি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে বিএনপিপন্থী প্রকৌশলীদের সংগঠন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে আছেন কিবরিয়া। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনের একটি অনুষ্ঠানে কেক কাটার সময় উপস্থিতির কারনে গোলাম কিবরিয়াকে বিগত আওয়ামীলীগের সময়ে নানা হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে। এক পর্যায়ে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। তাঁর পুরো পরিবারের সদস্যরা বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত।
ছাত্রদলের সাবেক এই নেতাকেও ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ হিসেবে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছেন ইশরাক। এ বিষয়ে তাঁর কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
ব্যানারে ছিল না ‘মাননীয় মেয়র’ : শপথ না নিয়েই নিজেকে মেয়র দাবি করা বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন গত ১৬, ১৭ ও ১৮ মে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের একটি মিলনায়তনে করপোরেশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিয়ে কয়েকটি সভা করেছেন। ওই সব সভায় টাঙানো ব্যানারে ইশরাক হোসেনের নামের পাশে ‘মাননীয় মেয়র’ ও ‘নির্বাচিত মেয়র’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন লেখা ছিল। তবে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল ইশরাক হোসেনের নামের পাশে ‘মাননীয় মেয়র’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক হোসেনের সঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটির সাবেক কাউন্সিলর বাদল সরদার ও মকবুল হোসেন এবং ঢাকা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
তাঁদের মধ্যে বাদল সরদার সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের অনুগত হিসেবে নগর ভবনে পরিচিত ছিলেন। এ জন্য তাঁকে সেরা কাউন্সিলর হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল বলেও নগর ভবনে আলোচনা ছিল। ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে বিএনপিপন্থী অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নগর ভবনে প্রবেশে বাধা দেওয়া হলেও বাদল সরদার কীভাবে সংবাদ সম্মেলনে পাশে বসেছেন, এমন প্রশ্নও ইশরাকের কাছে করেছিলেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু তিনি এর জবাব দেননি।
নগর ভবনে ইশরাক-সমর্থকদের অবস্থান : এদিকে গতকালও নগর ভবনের নিচতলায় ইশরাক-সমর্থকেরা অবস্থান নিয়েছিলেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তাঁরা সেখানে অবস্থান করেন। তাঁদের বেশির ভাগই ঢাকা দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন বলে জানা গেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গতকালের মারধরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নগর ভবনে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। আবারও অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা ঘটে কি না, তা নিয়ে বেশির ভাগ কর্মকর্তা ও কর্মচারী উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।
নগর ভবনে ইশরাক-সমর্থকদের ধারাবাহিক মহড়া চলতে থাকবে কি না, সে প্রশ্ন সংবাদ সম্মেলনে ইশরাকের কাছে করেছিলেন সাংবাদিকেরা। কিন্তু তিনি জবাব না দিয়েই সংবাদ সম্মেলন শেষ করেছেন।
গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনের সামনে ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে ইশরাক সমর্থক ও বিএনপি নেতাকর্মীরা। পরে ডিএসসিসি কর্মচারী ইউনিয়নও তাতে যোগ দেয়। আন্দোলনকারীরা নগর ভবনের প্রধান ফটক, বিভিন্ন দপ্তরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। এতে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে ঈদ ঘিরে ছুটির কদিন নগর ভবনে ইশরাক সমর্থকদের আন্দোলনে পাওয়া যায়নি। ঈদের ছুটির শেষে অফিস খোলার প্রথম দিন থেকেই ফের সেখানে আন্দোলন শুরু করেন ইশরাক সমর্থকরা। সে সময় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেবা কার্যক্রমে অচলাবস্থা কাটাতে নিজের তত্ত্বাবধানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন ইশরাক। জন্ম নিবন্ধন সনদসহ দৈনন্দিন জরুরি সব সেবা চালু থাকার ঘোষণা দিয়ে ইশরাক বলেছিলেন, অন্যান্য উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করা কর্মকর্তারা অফিস করতে পারবে না। এর মধ্যে নগর ভবনে কর্মচারীদের নিয়ে সভা করেন ইশরাক। সভার ব্যানারে তার নামের আগে লেখা ছিল ‘মাননীয় মেয়র’। এরপর গত ১৮ জুন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, মেয়াদ ‘শেষ হয়ে যাওয়ায়’ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের আর শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই।