সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত গতকাল বৃহস্পতিবার হাবিবুল আউয়ালের এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

দিনের ভোট রাতে করাসহ প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানার মামলায় হাবিবুল আউয়ালের ১০ দিন রিমান্ডের আবেদন করেছিল পুলিশ। শুনানি নিয়ে তাঁর ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

এ মামলায় হাবিবুল আউয়ালকে বুধবার সকালে রাজধানীর মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। একই মামলায় গত রোববার আরেক সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন সোমবার তাঁর চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।

প্রহসনের নির্বাচন করার অভিযোগে সাবেক তিন সিইসিসহ ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে গত রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন খান। মামলায় ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি কে এম নূরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তৎকালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে আসামি করা হয়। মামলায় রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের ধারা যুক্ত করার বিষয়ে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ আবেদন করলে বুধবার তা মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত।

শেরেবাংলা নগর থানায় এই মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, জাবেদ পাটোয়ারী, এ কে এম শহীদুল হক প্রমুখ।

২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন হয়েছে, আদালতে স্বীকার

কাজী হাবিবুল আউয়াল আদালতকে বলেছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল ডামি নির্বাচন। এটি ছিল প্রহসনের নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ার কারণেই ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন হয়েছে। গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোস্তাফিজুর রহমানের আদালতে শুনানিতে তাঁর প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন হাবিবুল আউয়াল। হাবিবুল আউয়ালের এমন উত্তরের পর তাঁকে আদালত প্রশ্ন করেন, তাহলে তিনি পদত্যাগ করলেন না কেন? আদালতের এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে যান হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, অতীতে কোনো সিইসি পদত্যাগ করেননি। হাবিবুল আউয়াল পরে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের অনিয়মের প্রসঙ্গ আদালতে তুলে ধরেন।

সংস্কার ছাড়া হাজার বছরেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না

ক্ষমতার লোভ এমন যে শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। মৌলিক সংস্কার ছাড়া ‘এক হাজার বছরেও’ নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। রিমান্ড আবেদনের শুনানিতে তিনি এ কথা বলেন। বেলা ১২টা ৫০ মিনিটে তাকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের হাজতখানায় আনা হয়। শুনানির জন্য বেলা ১টা ২৫ মিনিটে তাকে এজলাসে তোলা হয়।

রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ঢাকার মহানগর পিপি ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি বলেন, এই আসামি ২০২২ সাল থেকে ২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলে ২৪ সালের ৭ জানুয়ারি এদেশে কলঙ্কজনক নির্বাচন হয়। সেই ডামি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও ২-১ টি দল ছাড়া আর কেউ অংশ নেয়নি। নির্বাচন করে ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাতে। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতসহ অনেক বড় বড় দল অংশ নেয়নি। পূর্বেই জেনেছিল নির্বাচন হবে ডামি, লোক দেখানো, প্রহসনের নির্বাচন। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিকগুলোর সাথে তিনি বসেন। তবে তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দেননি।

ওমর ফারুক ফারুকী শুনানিতে বলতে থাকেন, এরপর তিনি (হাবিবুল আউয়াল) বলেছিলেন, কেউ নির্বাচনে না আসলে আমি কী বসে থাকব? ইসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। অথচ জনগণের ভোটাধিকারের হরণ করার দাম্ভিকতাপূর্ণ বক্তব্য দেন। ৫ অগাস্টের পর বুঝতে পেরে আত্মগোপনে চলে যান। মগবাজারের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অন্যায় করেছিলেন, এজন্য গাঢাকা দেন।

পিপি ফারুকী বলেন, এ ব্যক্তি কীভাবে সবার সামনে মিথ্যাচার করেছে। নির্বাচনের দিন বলে, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে, স্বতফূর্তভাবে জনগণ ভোট দিচ্ছে’। জনগণের সাথে কত বড় প্রতারণা করেছে। নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ২৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানায়। এর এক ঘণ্টা পর এসে জানায়, ভোট পড়েছে ৪০ শতাংশ। অথচ কেন্দ্র মানুষ নাই, কুকুর বসা। পরে সাংবাদিকদের এসে জানান, এক ঘণ্টার জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। নির্বাচন হচ্ছ, অথচ তিনি নিদ্রায় ছিলেন। কত বড় দায়িত্বজ্ঞানহীন- একটা কুলাঙ্গার আজকের এ প্রতারক হাবিবুল আউয়াল। সরকারের সাথে আতাঁত করে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করে নির্বাচন করে দিয়ে হাসিনাকে ক্ষমতা দিয়ে দেবে। এসময় তাকে শুনানি শেষ করতে বলেন বিচারক। পরে মামলায় ধারার বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ওমর ফারুক ফারুকী।

হাবিবুল আউয়ালের পক্ষে তার আইনজীবী এমিল হাসান রোমেল রিমান্ড আবেদন বাতিল চেয়ে জামিন আবেদন করেন। তিনি বলেন, বয়স ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে। অনেক অসুস্থ, বিভিন্ন রোগে জর্জরিত। ফ্যাসিস্ট দমাতে গিয়ে যেন আবার ফ্যাসিস্ট না হয়ে যায়।

এরপর আদালতের অনুমতি নিয়ে কথা বলেন আসামি হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, প্রসিকিউশনের বক্তব্যের সাথে আমিও একমত। নির্বাচনটি ডামি ও প্রহসনের নির্বাচন ছিল।

এ সময় তাকে থামিয়ে বিচারক বলেন, প্রত্যেক জেলায় নির্বাচনি ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়, যেখানে একজন যুগ্ম জেলা জজ পদমর্যাদার একজন দায়িত্বে থাকেন। আগে যার ভাতা ছিল ২২ হাজার টাকা, সেটা আপনি ৫ লাখে উন্নীত করেছেন। এতে কি জনগণের টাকা অপচয় হয়নি?

বিষয়টি জানা নেই দাবি করে হাবিবুল আউয়াল বলেন, পাঁচ বছরের মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করে হয়তো ভাতা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর বিচারক জানতে চান, এই যে ইনকোয়ারি কমিটি করা হয়েছিল, নির্বাচনের সময় কোথাও কি তারা সরেজমিনে গিয়েছিলেন?

তখন আউয়াল বলেন, একজন রিটার্নিং অফিসারের অধীনে ৪-৫টা সংসদীয় আসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাকে সহযোগিতা করতে আরও ৪-৫ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট রিটার্নিং অফিসার থাকেন। একটা নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ২ ভাগ দায়িত্ব কমিশনের, বাকি ৯৮ ভাগ দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে কাজ করা অফিসারদের।

নির্বাচনের আগে এমন অবস্থা জেনে আপনি পদত্যাগ করেননি না কেন? বিচারকের এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক সিইসি আউয়াল বলেন, ওই অবস্থায় পদত্যাগ করা সম্ভব ছিল না। আমার এক বন্ধুও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল পদত্যাগের কথা। আমি বলেছি, ‘তুমি যদি আগে বলতা- এমন ভয়ংকর নির্বাচন হবে, তাহলে আমি দায়িত্বই নিতাম না’।

অতীতের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বায়াত্তরের সংবিধান প্রণয়নের তিন মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত তেয়াত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসন পায়। সেই নির্বাচনও সুষ্ঠু ছিল না। ক্ষমতার লোভ এমন যে- শেখ মুজিবও তা সামলাতে পারেননি। ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তীতে তারাই আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে সংবিধান সংশোধন করে।

এসময় পিপি ওমর ফারুক ফারুকী উত্তেজিত হয়ে আদালতকে বলেন, তিনি নিজেকে জাস্টিফাই করছেন। তার এসব বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই।

এ সময় আউয়াল বলেন, জাস্টিফাই না করতে দিলে রিভলবার দিয়ে গুলী করে মেরে ফেলেন।

তখন উপস্থিত আইনজীবীরা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করলে এজলাসে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়।

নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব তুলে ধরে আউয়াল বলেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া আগামী একহাজার বছরেও এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

আধা ঘণ্টার শুনানি শেষে আদালত আসামি হাবিবুল আউয়ালের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেয়।