রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় আয়ানের কোলে থাকা অবস্থায় পুলিশ
আবারো গুলী করে আবু সাইদকে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য
মো: সিয়াম আহসান আয়ান। রংপুরে জুলাই আন্দোলনে সম্বয়ক। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় যখন আন্দোলন করছিলেন তখন পুলিশের গুলীতে শহিদ হন আবু সাঈদ। গুলীর সামনে বুক চিতিয়ে দেওয়া আবু সাঈদকে প্রথম সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন আয়ান। সেদিনের গল্প দৈনিক সংগ্রামকে বলেছেন তিনি। শহীদ আবু সাঈদের লাশ নিয়ে যখন পুলিশ লুকোচুরি খেলছিল তখন রংপুর মেডিকেলে উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়ার ৯ম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. কাজী মিজানুর রহমান। তিনিও কথা বলেছেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। রংপুরে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলেছেন ইবরাহীম খলিল।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব : সিয়াম আহসান আয়ান জানান, ১৫ জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ে ছাত্র লীগ আক্রমণের আগ পর্যন্ত রংপুরে আন্দোলন ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক। ১৬ জুলাই থেকে যুক্ত হই জুনিয়ররা। স্কুল কলেজও একসাথে যুক্ত হয়ে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেই। আমি রংপুর জেলা স্কুল ২৩ এর ব্যাচ। স্কুল থেকে বলা হয়, সবাই একত্রিত হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংহতি দেবে। আমরা যখন জেলা স্কুল থেকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাই তখন যাওয়ার পথে রংপুর পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে আমাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। লাঠিচার্জ করা হয়। মিছিল এগুতে এগুতে যখন খামার মোড় পর্যন্ত আসে তখন আমার কাছে ফোন আসে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে ছাত্রলীগ অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আক্রমণ করবে নিশ্চিত। আমরা গাছের ডাল হাতে নিয়ে যাই। আমি যখন আবু সাঈদ চত্বরে পৌঁছাই বেলা দুইটা চল্লিশের দিকে। তখন সেই চত্বরের নাম পার্কের মোড় ছিল। দেখলাম টিয়ার সেল, রাস্তায় ধোঁয়া। ওই সময় দেখি একটা ছেলে দুইহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে প্রথমে দুইবার শুট করলো। আমি তখনো যেহেতু আঘাত ছিল না, ভাবছিলাম রাবার বুলেটের মতো কিছু লেগে থাকবে, ফেটে যাবে। একদম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকে কোন একজন অফিসার চিল্লায়া উঠলেন, এতো ক্লোজ রেঞ্জে শুট করিয়েন না। একদম খুব জোরে। আমি ১৫ হাতের মতো দূরে থেকে সবকিছু শুনতেছি। তখন ভাবলাম এটা খুব মারাত্মক কিছু। আমি তখন চিন্তা করলাম দুইবার শুট খেয়েছে যেমনেই হউক ছেলেটাকে বাঁচানোর চেষ্টাটা করি। আমি দৌড়ে গেলাম আবু সাঈদ ভাইয়ের কাছে। তাকে ধরলাম। ধরে তোলার পর আবারো দেখলাম পুলিশ বন্দুক তাক করেছে আমাদের দিকে। এসআই সুজন একজন আর কনস্টবল আমীন। তাদের একজন যখন বন্দুক তাক করলো আমাদের দিকে, তখন আমি তোলে একটু ঘুরিয়ে নিলাম। যাতে শুটটা সাঈদ ভাইয়ের গায়ে না লাগে। পরের বার পুলিশ যখন গুলী চালায় সেইগুলীটা লাগে আমার গায়ে। আমার বাম পাশে ২১টা স্পিন্টার ঢুকেছিল। তারপর সাঈদ ভাইকে একটা নিরাপদ স্থানে নিলাম। মজার বিষয় হচ্ছে যে জিনিসটা গত দশ মাসে রিয়ালাইজ করেনি, ভিডিও ফুটেজটা চেক করলে বার বার দেখা যায়, মামলা থেকে সব জায়গায় লেখা আছে দুজন শুট করেছে। কিন্তু মেইন ফুটেজে যখন আমরা পর ৬/৭ জন সাঈদ ভাইকে নিয়ে কোনরকম পাশের চায়ের স্টলটা পর্যন্ত নিয়ে গেছি। আমি তুলে নিয়ে একটু এগোনোর আবু সাঈদ ভাই রাস্তায় পড়ে যান আমার হাত থেকে। তখন আরও কয়েকজন এগিয়ে আসে তাকে নেওয়ার জন্য। আমার ধারণা গুলীর প্রভাবে অর্থাৎ এই বুলেটের প্রভাবেই কিন্তু পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার পর তার মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করে। যেমন স্বাভাবিকভাবে সেভেন আপ কিংবা অন্য কোন কোমল পানীয়ের বোতল ঝাঁকুনি দিলে যে অবস্থা তৈরি হয়; সেভাবেই রক্ত বের হচ্ছিল। সাঈদ ভাইয়ের মুখ থেকে। সাঈদ ভাই আমার বাম পা-টা চেপে ধরে বলার চেষ্টা করছেন যে ভাই আমাকে বাঁচা। তার বলাটা শেষ হয় না। গলা পর্যন্ত রক্ত উঠে আসার কারণে বলাটা শেষ করতে পারেননি। বিভিন্ন রিপোর্টের কথা বাদ দিলেও আমার ধারণা, একদম কাছ থেকে তাকে গুলী করা হয়েছে। গুলীর কারণে তার ভেতরের কোন অঙ্গ ব্রাস্ট হয়ে রক্ত ক্ষরণ হয়ে তার মৃত্যুটা হয়েছে। আমরা যখন আবু সাঈদ নিয়ে এক কোনাকোনির যে রাস্তায়; তখন একজন লাল হেলমেট পরিহিত আরেকজন পুলিশ অফিসার দৌড়ে এসে আবারো গুলি করে (নাম আইডেনটিটি করা সম্ভব হয়নি)। ওইটা শেষ গুলী ছিল। তারপর সাঈদ ভাইকে রিকশায় নেওয়া হয়। মেডিকেল পর্যন্ত। আমি অবশ্য সেদিন মেডিকেল যাইনি। এরপর চার থেকে পাঁচ ঘন্টা মেডিকেল চত্বরেই ছিলাম।
মেডিকেল পর্ব : রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ম ব্যাচের ছাত্র মো. কাজী মিজানুর রহমান কথা বলেছেন দৈনিক সংগ্রামের সাথে। তিনি বলেন আমার বাসা রংপুর মেডিকেলের পাশেই। রংপুরে আন্দোলনে মাঝে মাঝে যাই। খুব বেশি সক্রিয় না। আমি বাবা মার একমাত্র সন্তান। ১৬ জুলাই যেদিন আবু সাঈদ শহীদ হন, সেদিন রাত ৯টার দিকে আকাশ ভাই ফোন দিলেন, আবু সাঈদের লাশ হাসপাতালে আছে। যাওয়া লাগবে। তারপর আমি আমার মোটর সাইকেল নিয়ে আকাশ ভাইসহ হাসপাতালে গেলাম। হাসপাতালে গিয়েই দেখলাম, রংপুরের সিটি মেয়র এবং তুহিন ওয়াদুদ স্যার (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক) এর কাছে বিচার দিচ্ছে যে পুলিশ আবু সাঈদের লাশ ছাত্রদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। তখন আমি আমার নবম ব্যাচের ভাইদের বললাম যে তোরা কই আছিস মেডিকেলে ছোটভাইদের সাহায্য লাগবে। আমরা অবশ্য আগে সক্রিয় ছিলাম না। কিন্তু ১৬ তারিখে যা হলো তখনতো আর বসে থাকা যায় না। এরপর আমার রুম মেট সালাফি ভাই ওনাকে নিয়ে এলাম। পরিবারের দাবি ছিল লাশের গায়ে কাটাছেড়া করা যাবে না। পুলিশ তাতে রাজি হয়নি। আমি তখন পোস্টমটেকের ঘরের কাছে গেলাম। দেখলাম আবু সাঈদের চাচাতো ভাই রুহুল ভাই, আকাশ ভাই, তুহিন ওয়াদুদ স্যার আছেন। পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি সেখানে ছিল। আবু সাঈদের পোস্ট মোটেম হয়ে যাওয়ার পর লাশ বের করবে। সেখানে একজন ডোম ছিল। লাশ বের করার জন্য আরেকজন মানুষ লাগে। তখন আমি আবু সাঈদের লাশ বের করার জন্য ধরলাম। সাথে আকাশ ভাইও ধরলেন। তখন রাত ১১টা ২০ বাজে। গাড়িতে লাশ তোলা হলো। এখন গাড়ির সাথে কে যাবে ? আমি যাওয়ার সাহস করলাম যে, পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। ছাত্রলীগের ছেলেরা হামলা করতে পারে এই আশঙ্কায়।