বাহিনীতে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার সংযোজন করার উদ্যোগ নেয় পুলিশ। এজন্য আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে সরকার টু সরকার (জিটুজি) পদ্ধতিতে ৪২৮ কোটি ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৬ টাকায় রাশিয়া থেকে দুটি হেলিকপ্টার কেনার জন্য দুই দেশের মধ্যে ২০২১ সালের ১৯ নবেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী প্রথম কিস্তিতে ২১৪ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৮, দ্বিতীয় কিস্তিতে ৮৫ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৩সহ সর্বমোট ২৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫২১ টাকা মূল্য পরিশোধও করা হয়। অবশিষ্ট টাকা ব্যাংকে জমা রাখা আছে। অথচ হেলিকপ্টার সরবরাহকারী রাশিয়ান কোম্পানীর ওপর রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি গোপন রেখেই পুলিশ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বলে জানা গেছে। বিশেষ মহলকে খুশি করার জন্য নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত কোম্পানীর কাছ থেকে হেলিকপ্টার কেনার উদ্যোগ নিয়ে এখন ৩০০ কোটি টাকার আর্থিক ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। এখন পরিশোধকৃত টাকা ফেরাতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক পর্যায়ে দু’দেশের মধ্যে চিঠি চালাচালি। সর্বশেষ কুরবানীর ঈদের আগে অনুষ্ঠিত পুলিশ, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ত্রিপক্ষীয় এক সভায় পরিশোধকৃত টাকা ফেরাতে জোর তৎপরতার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রে জানা গেছে।

পুলিশ সদর দফতর সুত্র জানায়, পুলিশের জন্য রাশিয়া থেকে কেনা দুটি হেলিকপ্টারের সরবরাহ স্থগিত করা হয়েছে। হেলিকপ্টার দুটি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর (জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টারস) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার। সুত্র মতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হেলিকপ্টার সরবরাহ স্থগিত রাখার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ১৯ জানুয়ারি পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজি) চিঠি দিয়েছে। এই দুটি হেলিকপ্টারের মূল্যের বেশির ভাগ অর্থ ইতিমধ্যে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে। এই দুটি হেলিকপ্টারের একটি তৈরি সম্পন্ন হয়েছে এবং বাংলাদেশ থেকে আট কর্মকর্তা রাশিয়া গিয়ে পরীক্ষামূলক উড্ডয়নও দেখে এসেছেন। এই দুটি হেলিকপ্টার পুলিশের এভিয়েশন উইংয়ে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। চারজন সহকারী পুলিশ সুপার পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। হেলিকপ্টার দুটি এমআই-১৭১ এ-২ মডেলের।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইজিপিকে দেয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টারস কোম্পানির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগের নিষেধাজ্ঞা (সাংশন) রয়েছে। তাই পুলিশের জন্য জিটুজি পদ্ধতিতে কেনা হেলিকপ্টারের সরবরাহ পরবর্তী সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতি: উপমহাপরিদর্শক (ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট) মো: আশরাফুজ্জামান বুধবার দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে হেলিকপ্টার সরবরাহের বিষয়টি স্থগিত করা হয়েছে। বিষয়টি রাশিয়ার সংশ্লিষ্টদের ই-মেইলের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিশোধকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন উল্লেখ করে আশরাফুজ্জামান বলেন, এজন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে কাজ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়সহ পুলিশ। দু‘দেশের মধ্যেই ক’টনৈতিক পর্যায়ে চিঠি চালাচালি চলছে। এ নিয়ে কয়েকদফা বৈঠকও হয়েছে। সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছে কুরবানীর ঈদের আগে। বৈঠকে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে কূটনৈতিক পর্যায়ে অর্থ ফেরত আনার সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

ঝুঁকিতে অর্থ ফেরত : সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাশিয়া থেকে কেনা দুটি হেলিকপ্টারের একটিও আনা সম্ভব হচ্ছেনা নিষেধাজ্ঞার কারণে। এর মূল্য বাবদ পরিশোধিত অধিকাংশ টাকাও ফেরত না আসার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার রাশিয়ার যে প্রতিষ্ঠানের সাথে হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করেছিল , তাদের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র‘র নিষেধাজ্ঞা থাকায় কেনার কথা বাদ দিয়ে এখন অর্থ ফেরতের শংকায় পড়েছে সরকার। জানা গেছে, চুক্তির দুই মাসের মাথায় নিষেধাজ্ঞার পরও পর্যায়ক্রমে তিন অর্থবছরে মূল্য পরিশোধ করায় এ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। গত বছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ কর্মকর্তা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করতে রাশিয়া সফর করেছেন। চুক্তির মধ্যস্থতাকারীকে চার শতাংশ হারে কমিশনও দেওয়া হয়েছে।

২০২১ সালের ১৯ নবেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স থেকে এমআই ১৭১এ২ মডেলের দুটি হেলিকপ্টার কেনার জন্য চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। দরপত্র ছাড়াই জিটুজি পদ্ধতিতে হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ৪২৮ কোটি ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৬ টাকা। চুক্তি অনুযায়ী মোট মূল্যের ৭০ শতাংশ হারে প্রথম কিস্তিতে ২১৪ কোটি ৬ লাখ ২৪ হাজার ৬৫৮, দ্বিতীয় কিস্তিতে ৮৫ কোটি ৬২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৬৩সহ সর্বমোট ২৯৯ কোটি ৬৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫২১ টাকা পরিশোধও করা হয়। অবশিষ্ট টাকা ব্যাংকে জমা রাখা আছে। জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স’র ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ২০২২ সালের প্রথম দিকে। বিষয়টি জানার পরও ২০২৪ সাল পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ‘জেএসসি রাশিয়ান হেলিকপ্টার্স’র ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। এরপরই নড়াচড়া শুরু হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হেলিকপ্টার সংযোজনের বিষয়টির সর্বশেষ অবস্থা জানতে গিয়েই ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি। এরপর এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। তখন বিষয়টি দেখার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়। সূত্র জানায়, জিটুজি পদ্ধতিতে হেলিকপ্টার কেনা হলেও এর মধ্যস্থতাকারীকে ক্রয়মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে ১৭ কোটি ১২ লাখ টাকা কমিশন দেয়া হয়েছে। এ মধ্যস্থতাকারী হচ্ছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইজিপির ক্যাশিয়ার। নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানা সত্ত্বেও গত বছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ জন কর্মকর্তা প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন (পিএসআই) করতে রাশিয়া সফর করেছেন। আট সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এমটিএমসি) মো. নাসির উদৌলা।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ও ইউক্রেন সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এরপর রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদনকারী সব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞা জারির মাত্র ২ মাস আগে ২০২১ সালের ১৯ নবেম্বর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে দুটি হেলিকপ্টার কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ। দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে তিন অর্থবছরে ৪২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করার কথা। সেক্ষেত্রে পরিশোধ করা হয়েছে ২৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। শর্তমোতাবেক উল্লিখিত সময়ের মধ্যেই হেলিকপ্টার দুটি সরবরাহ করার কথা রাশিয়ার। সে অনুযায়ী তারা একটি হেলিকপ্টার চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি, অপরটি এপ্রিল মাসে সরবরাহ করার কথা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, চুক্তির মাত্র ২ মাসের মাথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ান জেএসসি হেলিকপ্টার্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তখনই সরকারের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি ছিল। কারণ চুক্তির দু’মাস পর তেমন অর্থও পরিশোধ করা হয়নি। চুক্তি থেকে বেরিয়ে না এসে, উলটো বছরভিত্তিক ধারাবাহিকভাবে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ করার মধ্যে বড় ধরনের দুর্নীতি আছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তারা আরও জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিবাদ কবে থামবে, কবে চুক্তি অনুসারে হেলিকপ্টার সরবরাহ নেওয়া যাবে এসব বিষয়ে নিশ্চয়তা ছাড়াই রাষ্ট্রীয় অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। এত বড় ঝুঁকি দুর্নীতিবাজরা এমনিতে নেয়নি। বরং এই কেনাকাটায় তাদের স্বার্থ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া হেলিকপ্টার সরবরাহ করলেও এই মুহূর্তে সরকার তা গ্রহণ করতে পারবে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে হেলিকপ্টার নেয়ার ঝুঁকি সরকার নেবে না। ফলে হেলিকপ্টার কিংবা টাকা কবে পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বাংলাদেশে এর আগে পুলিশের বিশেষ শাখা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের এয়ার উইংয়ের দুটি হেলিকপ্টার থাকলেও, পুলিশ সদর দপ্তরের এয়ার উইং এই প্রথম কোন আকাশযান সংযোজনের উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশ পুলিশের নৌ-শাখাও রয়েছে। ফলে হেলিকপ্টার সংযুক্ত হলে স্থল, নৌ ও আকাশ পথে পুলিশের ত্রিমাত্রিক কর্মকা- বৃদ্ধি পাবে বলে তৎকালীন সময়ে কর্মকর্তারা আশা করেন। সেনাবাহিনীর বাইরে আধা-সামরিক বাহিনী বিজিবির এয়ার উইং রয়েছে, যাদের একাধিক হেলিকপ্টার রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের জুলাই মাসে চারজন অফিসারকে বেসিক বিমান চালনা প্রশিক্ষণের জন্য আর্মি এভিয়েশন স্কুলে পাঠানো হয়েছিল। মুশফিকুর হক (৩৫তম বিসিএস), সারোয়ার হোসেন (৩৫তম বিসিএস), ফাতেমা তুজ জোহরা (৩৬তম বিসিএস), এবং আবুল হোসেন (৩৭তম বিসিএস) ১৬ মার্চ, ২০২২ সালের মধ্যে তাদের একক বিমান প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও, বেশ কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর এবং কনস্টেবল র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এয়ার উইংয়ের মাধ্যমে হেলিকপ্টার রক্ষণাবেক্ষণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। উদ্ধার অভিযান, জরুরি প্রতিক্রিয়া এবং আকাশ নজরদারিতে সহায়তা করার জন্য পুলিশের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ বিমান চলাচল শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, বিশেষ করে প্রত্যন্ত বা দুর্যোগপ্রবণ এলাকায়। একজন সহকারী মহাপরিদর্শককেও উইংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এখন শাখাটি নিষ্ক্রিয়।