হাসিনার আয়না ঘর থেকে একের পর এক ভয়াল অভিজ্ঞতা, শরীরে ক্ষতচিহ্ন, আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ফিরে এসেছেন শত শত মানুষ। কেউ কেউ ফিরে আসেননি, হারিয়ে গেছেন চিরতরে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে এমন গুম, অপহরণ ও ভয়ংকর নির্যাতনের বিস্তৃত অভিযোগ এখন আর শুধু পরিবার-পরিজনের কান্নায় আটকে নেই; উঠে এসেছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত নথিতে।

সম্প্রতি গুম কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- কিভাবে একজন বন্দিকে দীর্ঘ দিন আটক রাখার পর আদালতে হাজির করে তাদের শিখিয়ে দেয়া কথা বলানো হতো। আদালতে নির্দিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করে স্বীকারোক্তি না দিতে চাইলে বার বার রিমান্ডে নেয়ার ভয় দেখনো হতো। আবার কখনো ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দেয়া হতো। শেখানো কথা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বললে তাকে মুক্তি দেয়ার প্রলোভন দেখানো হতো। তবে মুক্তির প্রলোভনেও অনেকে আদালতে যেয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিতে চাইতেন না। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে সত্য কথা বললেও ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রুক্ষেপ করতেন না। এভাবে গুম কমিশনে উপস্থিত হয়ে জীবনের দুর্বিসহ দিনগুলির বর্ননা দিয়েছেন ফিরে আসা অনেকে। এখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের আগের কয়েকটি ঘটনার নিজেদের বক্তব্য হবহু তুলে ধরা হলো-

চার মাস পরে আমাকে নিয়ে গেল, চোখ বেঁধে নিয়ে গিয়ে বলতেছে, তুমি কি এখান থেকে বের হতে চাও, নাকি এভাবেই জীবন শেষ হয়ে যাবে? আমি বললাম, অবশ্যই আমি এখান থেকে বের হতে চাই। তখন বলে, ঠিক আছে, তাহলে আমরা যে কথাগুলো বলবো, তুমি কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তাই বলবা । ... তুমি যদি এটা বলো, তাহলে তুমি এখান থেকে বের হবা। আর যদি না বলো, তাহলে এখানে তোমাকে ক্রসফায়ার দিয়ে দিব, তুমি মরবা। একটা কাগজে লিখে দিয়েছেন, এইভাবে এইভাবে তুমি স্বীকারোক্তি দিবা। আর না হলে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবো না। যদি স্বীকারোক্তি না দাও, তাহলে তোমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি প্রথমবার দিতে চাইছিলাম না। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ডাক দিয়ে বললেন, আপনাদের আসামি তো ভালো করে স্বীকারোক্তি দিচ্ছে না। তারপর উনারা আমাকে বাইরে নিয়ে গেছেন। বাইরে নিয়ে গিয়ে শাসিয়েছেন। ... আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে কেঁদে কেঁদে বললাম, স্যার, আমাকে আমার ভাইয়ের কাছে যেতে দেন। আমার ছোট ছোট ভাইয়ের জন্য আমার মনটা, প্রাণটা কাঁদছে। আমার মায়ের জন্য কাঁদছে। আমার মায়ের কাছে যেতে দেন। এইভাবে আকুতি করলাম। ওই বিভিন্ন জিনিস লেখাইছে, মুখস্ত করাইছে, বলছে এগুলি বলবি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে। নাইলে কিন্তু যতবার খুশি, ততবার আমরা রিমান্ড আনবো। লাস্টের চার দিন সময় দিছে যে, তোমারে চার-পাঁচ দিন সময় দিলাম, এটা মুখস্ত করবা.... তুমি এই কথাগুলাই বলবা... যদি না বলো এগুলা, তা তোমারে পাঁচ-সাতটা মামলা দিয়া দিমু, আর যদি বলো, তাহলে তোমার একটা ছোট্ট মামলা দিয়া ছেড়ে দিমু। আমাকে তারা আগে থেকেই ফরমেট সারারাত পড়াইছে, এইটা এইটা বলবা। সকালবেলা আবার পড়াইছে, কোর্টে যাবা, যা যা জিজ্ঞাসা করুক, তুমি এটাই বলবা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে।

ম্যাজিস্ট্রেটকে আমি বলছি, স্যার, আমি একটু আপনার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাই... ম্যাজিস্ট্রেটকে যখন আমি বলছি, স্যার, এগুলা আমি করি নাই। এরা আমারে মারধর করে, আমারে জোর করে এগুলা বলাই দিছে। ম্যাজিস্ট্রেট বলছে, ঠিক আছে, আমি দেখতেছি। কিন্তু তারপরও সে এটা আমার বিপক্ষে লেখছে। কারণ, এতদিন আমারে গুম রাখছে, অন্য কোনদিন কিন্তু তারা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আনতে পারতো না? কিন্তু আসলে যেদিন তাদের পছন্দের ম্যাজিস্ট্রেট ছিল, সেদিনই তারা আমারে কোর্টে হাজির করছে।

তখন জজ সাহেব বলল, তোমাদের কোন উকিল আছে কিনা। আমাদের গুম অবস্থায় সরাসরি ওখানে নিয়ে গেছে। কেমনে উকিল ধরবো? বললাম, উকিল নাই। তো জজ সাহেব চার দিনের রিমান্ড দিলেন। কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করছে, আপনাদের তো উকিল নাই, আপনাদের কিছু বলার আছে কিনা? তখন আমরা বলছি, স্যার, আমাদের বলার আছে...। আমাদের এই রিমান্ড কীভাবে হবে, আমরা তো এখানে ছিলামই না। এইভাবে আমাদের যখন পুরো গুমের ঘটনা বর্ণনা করছি, তখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছে। উনি তখন বলছে, আচ্ছা, ঠিক আছে। এই যে উনারা বলতেছে যে, উনাদেরকে গুম করে রাখা হয়েছে, তো আপনি তো বলতেছেন যে আপনারা গত পরশুদিনে উনাদেরকে গ্রেফতার করছেন, তাহলে এখন কি জবাব দিবেন? তো তখন আমাদেরকে যে রিমান্ড চেয়েছিল, চট্টগ্রামের একজন পুলিশ কমিশনার, উনি বলছে, উনারা ট্রেনিং প্রাপ্ত। ট্রেনিং প্রাপ্ত না হলে কি এই ভাবে বলতে পারে? কারণ বলতেছে, ওরা যদি গুমে থাকে, তাহলে ওদের মোচ কাটা কেন? ওদের পরনে পরিষ্কার পোশাক কেন? অথচ মিডিয়াতে শো করার আগের দিন মোচ কেটে, পরিষ্কার পোশাক দিয়ে আমাদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে। পরবর্তীতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আমাদের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে এবং বলে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোন ধরনের নির্যাতন বা শারীরিক টর্চার ছাড়া রিমান্ড শেষ করতে হবে।

আমি বললাম, স্যার, আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। উনাদেরকে অর্থাৎ পুলিশকে আপনি বের করেন রুম থেকে। মাহমুদুল হাসান স্যার বলছেন, উনারা বের হবে না, যা বলার এখানে বল। আমি বলছি, স্যার, আমাকে উনারা গুম রাখছে। আমার বাবা-মা জানে না আজ পর্যন্ত আমি বেঁচে আছি কি মরে গেছি। এই যা লেখছে, আমাকে মুখস্ত করানো হইছে। স্যার, আমি এই সম্পর্কে কিছুই জানি না। মাহমুদুল হাসান স্যার কম্পিউটারে টাইপ দিয়ে অনেকগুলি লেখা কেটে দিছে। আরও লেখা বড় ছিল। কই দেখো, অনেক লেখা কেটে দিছি, আর কাটা যাবে না। যা আছে এখানে সাইন করো। আমি বললাম, স্যার, আপনার সাথে আমার কথা আছে। স্যার, আমার সামনে পরীক্ষা। স্যার, আপনি উনাদেরকে বের করেন। কোনভাবেই উনাকে আমি ম্যানেজ করতে পারলাম না। পরবর্তীতে যখন আমি এটা পড়তে গেলাম আবার, ম্যাজিস্ট্রেটের লেখাটা, তখন উনি আমাকে বলতেছে, তোমার তো এত জায়গা- জমি নাই যে আমি লিখে নিয়ে যাব। সাইন করতে বলছি, সাইন করো। . আমাকে উনি কোন সুযোগ দেয় নাই। কোন সময় দেওয়া হয় নাই।

এরপর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করছিল, কিন্তু ১৬৪ আমাকে মাইরা করছে ... আমার হাত বাঁধা, আমার দুইটা হাত বাঁধা। ম্যাজিস্ট্রেট আমারে জিজ্ঞেস করতেছে আর লিখতেছে। একবার জিজ্ঞেস করছে, আপনার বাসায় কি লাইব্রেরি আছিল? আমি বলছি, আমার বাসায় বই ছিল, লাইব্রেরি ছিল। তো আপনারা কি ওখানে বসে বন্ধুবান্ধব আড্ডা দিতেন? আমি বলছি, মাঝে মাঝে আসতো, গল্প করতাম... এই কথাটা আমি বলছি। কিন্তু সে এখানে যখন লেখছে, তার হাতের লেখা, সে লেখছে যে, আমি জিহাদি কর্মকা-ে জড়িত ছিলাম.... আমি তো তাকে এই কথাটা বলি নাই কখনো.... সে তো তার মত করে লিখল। ... র‌্যাবের লোকরা যখন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি করানোর জন্য রুমে ঢুকায়, তখন আমার চোখ বাঁধা। এটা যে ১৬৪ ধারার জন্য নেয়া রুম, সেটাও তো আমি জানি না। র‌্যাব থেকে আমারে বলছে, আমরা যেভাবে শিখাইছি, সেভাবে বলবি। যদি না বলস, এখান থেকে বাইর আনার পরে তুই আর জীবন দেখবি না।

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে গেছে... তো আমি উনার কাছে বললাম, এরা আমারে সদরঘাট থেকে এরকম এরকম কইরা নিয়ে আসছে। আমারে এদিকে আটকা রাইখা এতদিন আমারে মারছে, পিটাইছে। আমি জানি না, আমার বাসায় এরা কেমন আছে। ওরা জানে না আমি কেমন আছি তো উনি বলতেছে, কি করমু ভাই? আপনার নাম তো এজহারের মধ্যে আছে। কয়, এখন কি করমু? যেই মামলা, আপনারে রিমান্ড তো দেওয়াই লাগে। তো আমি বললাম, ‘আমি এতটা দিন এগো কাছে ছিলাম।” “কই ছিলেন?” আমি বললাম, র‌্যাব দিয়া গেছে। র‌্যাবের কাছে ছিলাম? র‌্যাব অফিসে ছিলেন? বললাম, “জি।” “কি করমু এখন? এটা তো নিয়ম, দেওয়াই লাগে। তো উনি আবার তিন দিনের রিমান্ড দিছে।