তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভা নবেম্বরেই শেষ হয়ে যাবে । ‘সংস্কার কমিশন থেকে ২৩টি আশু বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব তোলা হয়েছে। মন্ত্রণালয় পর্যালোচনা করে ১৩টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করছে। নবেম্বরে ক্যাবিনেট ক্লোজড হয়ে যাবে, যা করার আগামী মাসের মধ্যে করতে চাই।’
গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে তথ্য উপদেষ্টা এ কথা বলেন। ডিআরইউ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন। মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিআরইউর সভাপতি আবু সালেহ আকন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল।
মাহফুজ আলম বলেন, ‘এগুলো খুব বড় কিছু, এ রকম নয়। কিন্তু আমাদের সময়সীমা আগে ছিল ৩ মাস, এখন আছে এক মাস। কারণ এই জিনিসগুলো ক্যাবিনেটেই করতে হবে অথবা নীতিমালা প্রণয়ন করে করতে হবে। যেগুলো নবেম্বরে পরে আর করতে পারব না।’
তিনি বলেন, নবেম্বরে ক্যাবিনেট মিটিং ক্লোজড হয়ে যাবে। এরপরে নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেবে। আইন প্রণয়নের যেই জায়গাগুলো আছে সেগুলো আগামী মাসের মধ্যে সমাধান করতে চাই। আর যেগুলো আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনার মাধ্যমে করা সম্ভব, সেগুলো করে ফেলব।
অনেকে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী বা বিভিন্ন পরিচয়ে টেলিভিশন টক শোতে বসে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ‘বড় বড় কথা বলছেন । ওই সাহস গত ১৫ বছরে কোথায় ছিল?
সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলা রোধে আইন করা যায় কি না? জবাবে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, সাংবাদিকতার পরিমন্ডল থেকে যদি ‘ব্যাড অ্যাপল’ (খারাপ মানুষ) না সরানো যায়, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন যদি থেকে যায়, তাহলে অবশ্যই সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ হবে।
এ প্রসঙ্গে আলোচনায় উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘যারা ভায়োলেন্স করবে, আজকে যদি সুযোগ পায়, আজকেই আমাদের মেরে ফেলবে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে সাংবাদিক পরিচয়ে বা বিভিন্ন পরিচয়ে, বুদ্ধিজীবী পরিচয়ে। টেলিভিশন টক শোতে বসে বসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলতেছে। ওই সাহস কোথায় ছিল গত ১৫ বছরে?’ এরপরও সরকারের পক্ষ থেকে ‘খুব বেশি’ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়নি উল্লেখ করে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘এ জন্য যে আমরা চাই না যে আমরা কোনো হস্তক্ষেপ করি।’
সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিয়ে আলোচনায় বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ এসেছে জানিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, তারা প্রশ্ন তুলেছে যে এমন আইন ফ্যাসিস্টের দোসর ছিল, এখন বিভিন্ন হাউসে রয়েছে, তাদের সুরক্ষা দেবে। স্থানীয় পর্যায়ে যারা বিভিন্ন দলের দালালি করে, তারা সুরক্ষা পাবে।
গত ১৫ বছরে ‘অপসাংবাদিকতা’র জন্য কেউ অ্যাপোলজি (ক্ষমা প্রার্থনা) করেনি উল্লেখ করে মাহফুজ আলম বলেন, তাদের ভূমিকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। তাহলে কাকে ভরসা করে আইনটা করা হবে?
নতুন দুটি গণমাধ্যমের অনুমোদন দেওয়া নিয়ে লেখালেখি হওয়ার কথা তুলে ধরে এ ক্ষেত্রে তথ্য মন্ত্রণালয় কী ভাবছে, তা জানতে চান একজন সাংবাদিক। জবাবে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, দেশে বিকল্প গণমাধ্যম ছাড়া ‘বাকশালি ইকোসিস্টেম’ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই তিনি বিকল্প মিডিয়া দেবেন।
তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘যখন আমরা মালিকানার ফাইলগুলো দেখি, অধিকাংশ মালিক এখনো আওয়ামী লীগের। এখনো আওয়ামী লীগের মালিকানা পরিবর্তন করা হয় নাই। ওনারা বিদেশ থেকে বসে বসে এখনো এখানে টেলিভিশন চ্যানেলে যে আয় হয়, সেটার থেকে ওনারা পাচ্ছেন। পত্রিকা অফিস থেকে ওনারা পাচ্ছেন।’
মাহফুজ আলম বলেন, পুরোনো বন্দোবস্তের লোকেরা, পুরোনো বড় বড় মিডিয়া হাউস যারা আছে, তারা চায় না যে দেশে কোনো অলটারনেটিভ মিডিয়া (বিকল্প গণমাধ্যম) হোক। সে জায়গা থেকে বিভিন্নভাবে এটাতে (দুই গণমাধ্যমের অনুমোদন) ‘ফ্রেমিংয়ের’ চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনের কারণে যদি তাকে পদ থেকে সরেও যেতে হয়, তাহলেও তিনি নতুন মিডিয়ার লাইসেন্স দেবেন বলে উল্লেখ করেন তথ্য উপদেষ্টা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মিডিয়ায় ‘ফ্রেশ ব্লাড’ দরকার। যেহেতু তাঁরা কোনো মিডিয়া বন্ধ করছেন না, তাই নতুন মিডিয়া দেবেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা ইথিক্যাল জার্নালিজম চাই। দেখা যাচ্ছে যে এই জার্নালিজমটা অনেকাংশে করা সম্ভব হয় না, যদি আপনি একজন সাংবাদিককে ১০ হাজার, ৫ হাজার টাকা বেতন দেন। এটা তো সম্ভব না। পুরো পৃথিবীতে আমার মনে হয় জার্নালিজমের সুরক্ষার বিষয়টি একটা বড় ব্যাপার। সেই জায়গাটিতে আমরা যেতে চাই।
শফিকুল আলম বলেন, যেসব তরুণ সাংবাদিক পেশায় যোগ দিচ্ছেন, তারা যেন একটি সম্মানজনক বেতন পান, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্মানজনক বেতন না পেলে যেটা হয় যে এক ধরনের লেজিটভিত্তিক (অবৈধ) সাংবাদিক সমাজ তৈরি হবে না। আর তা না হলে রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক সরকারগুলো তখন সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে।
তিনি বলেন, ইউনিয়নের নেতারা আমাদের বিক্রি করে দেন, পূর্বাচলে একটি প্লট নেন। এভাবে বছরের পর বছর এই নেতারা আমাদেরকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু দেখা যায়, একজন সাধারণ সাংবাদিক যিনি এটাকে খুব সম্মানজনক পেশা হিসেবে নিয়েছেন তিনি নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন। মানুষকে তথ্য জানানোর যে দায়িত্ব, এটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব। দেশের স্থিতিশীলতার জন্য এর চেয়ে বড় দায়িত্ব খুব কম আছে। আপনার তথ্যের উপরে দেশের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। আপনি একটা ভুল তথ্য দিলে দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়।
প্রেস সচিব বলেন, যে ছেলেটা আজকে জার্নালিজম পেশাকে বেছে নিল, সে যেন একটি মৌলিক ন্যূনতম ভালো বেতন পায়। যাতে তাকে কেউ কিনতে না পারে, তাকে যেন একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলতে না পারে তুমি এভাবে নিউজটা করো। আমরা চাই ভালো, নির্ভীক জার্নালিজম, যে জার্নালিজম সমাজকে আরও এগিয়ে নিবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার ওয়েবসাইট তৈরি হয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকে আছে, যারা নিউজ চুরি করে একদম সোজা বাংলায় বলা যায় এরা চোর। অন্যদের নিউজ কপি-পেস্ট করে। এটা তো আমরা চাই না। সাংবাদিক অবশ্যই সে তার নিজস্ব প্রচেষ্টা দিয়ে একটা রিপোর্ট করবে। এই রিপোর্টটা করার জন্য যে মেহনত, খাটনি দরকার, সে করবে। আর সেটার তো আমাদের দাম দিতে হবে। সেই দামটা দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাঙের ছাতার মতো ওয়েবসাইটগুলো হচ্ছে, যারা কপিরাইট লঙ্ঘন করে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও দেখা যায় যে একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়। বলে, দেশে এই সরকার ফ্রিডম অব স্পিচ (বাক-স্বাধীনতায়) বিশ্বাস করে না। সেজন্য সাংবাদিকদের মৌলিক বেতনটা বাড়ানো খুবই জরুরি।