ইবরাহীম খলিল : আজ ২৮ জুলাই সোমবার। ২০২৪ সালের এই দিন ছিল রোববার। এদিন কোটা আন্দোলনকারীদের ধরতে দেশজুড়ে ভয়াবহ আতঙ্ক তৈরি করা হয়। যাকে সামনে পাওয়া যায় তাকেই গ্রেফতার করা হয়। আন্দোলন দমনে মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নুসরাত তাবাসসুমকে হেফাজতে নেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। ভোরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। দেশব্যাপী ক্র্যাকডাউন চালানো হয়। শিক্ষার্থী এবং তরুণ সমাজ কেউ বাসায় থাকতে পারেনি। বাধ্য হয়ে গোপন স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া তরুণদের। গ্রেফতারের লাইন দীর্ঘ করতে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ২০০ টিরও বেশি মামলায় অভিযুক্ত করা হয় কয়েক লক্ষ মানুষকে।
এদিন ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ক এক ভিডিও বার্তায় সব কর্মসূচি প্রত্যাহারের কথা বলতে বাধ্য করা হয়। ডিবি কার্যালয়ে ধারণ করা এই ভিডিও বার্তা রোববার রাত নয়টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। ওই ভিডিও বার্তায় কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করতে দেখা যায়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘আমাদের প্রধান দাবি ছিল কোটার যৌক্তিক সংস্কার। এটি সরকার ইতিমধ্যে পূরণ করেছে। এখন শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাই। সার্বিক স্বার্থে আমরা এই মুহূর্ত থেকে আমাদের সব কর্মসূচি প্রত্যাহার করছি।
নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাতজন সমন্বয়ককে তিন দিন আগেই ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়। তার সাথে অন্যরা ছিলের আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, নুসরাত তাবাসসুম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল শাখার সমন্বয়ক) ও আরিফ সোহেল (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমন্বয়ক)। ভিডিও বার্তায় আরিফ সোহেল ছাড়া অন্য ছয় সমন্বয়ককে দেখা যায়। এদিন সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ডিবির হেফাজতে নেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। পুলিশ যদি মনে করে তাঁরা ঝুঁকিমুক্ত, তখনই তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
রাতে ছয় সমন্বয়কের ওই ভিডিও বার্তা আসার কিছুক্ষণ আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। তাতে লেখা হয়, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন। তাই তাঁদের ডিবি কার্যালয়ে এনে কথা বললাম, কী কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁদের কথা শুনে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের নানা পরিকল্পনার কথা জানানোর পর তাঁদের উদ্বেগ দূর হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টিম ডিবি, ডিএমপি বদ্ধপরিকর। ওই পোস্টে সংযুক্ত পাঁচটি ছবিতে হেফাজতে থাকা সাত সমন্বয়কের সঙ্গে এক টেবিলে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদকে খাবার খেতে দেখা যায়। তবে ভিডিও বার্তায় কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা ছয়জন সমন্বয়ক দিলেও এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিবৃতি পাঠান একাধিক সমন্বয়ক। এই বক্তব্য ‘সাজানো’ এবং ‘জিম্মি করে’এই বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন আত্মগোপনে থাকা অন্য দুই জন সমন্বয়ক।
নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের কিছুক্ষণ পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল কাদের একটি বিবৃতিতে বলেন, সমন্বয়কদের জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে যে স্টেটমেন্ট দেওয়ানো হইছে, সেটা কখনোই জাতির নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আটককৃত সমন্বয়করা ভয়ভীতির মুখে গোয়েন্দা সংস্থার লিখে দেওয়া যে বক্তব্য কেবল রিডিং পড়ে গেছে, আমরা সেই বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি এবং একইসাথে জোরপূর্বক বক্তব্য আদায় করার মতো সরকারের এমন জঘন্য কাজের তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
মধ্যরাতে ‘সমন্বয়কদের কাছ থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি আদায়, সারা দেশে বিনা বিচারে হত্যা, গুম-খুন, মিথ্যা মামলা ও গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে’ সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেন মুক্ত থাকা কয়েকজন সমন্বয়ক। ঢাকার আটটি স্থানে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানান সমন্বয়করা। এ স্থানগুলো হলো সায়েন্স ল্যাব, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ নম্বর গেট, জাতীয় প্রেস ক্লাব, উত্তরার বিএনএস সেন্টার, মিরপুর-১০, মিরপুরের ইসিবি চত্বর, রামপুরা ও মহাখালী।
এদিকে টানা ১০ দিন বন্ধ থাকার পর রোববার (২৮ জুলাই) সারা দেশে মোবাইল ইন্টারনেট তথা ফোরজি সেবা চালু হতে শুরু করে। কিন্তু ফেসবুক, টিকটক এখনই চালু করা হয় না। এদিন বিকেল ৩টা থেকে ফোরজি নেটওয়ার্ক সেবা পাওয়া যায়। এ সময় বাংলাদেশ সচিবালয়ে ফোরজি সেবা মিলে। তবে শুরুতে ধীরগতি থাকবে বলে অপারেটররা জানিয়েছে।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক রোববার (২৮ জুলাই) সকালে আগারগাঁওয়ে বিটিআরসিতে মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ফোরজি নেটওয়ার্ক চালুর কথা জানান। আর গ্রাহকেরা তিন দিনের জন্য ৫ জিবি ডাটা পাবেন। পলক বলেন, আজকে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি, আজকে বিকাল ৩টার সময় মোবাইল নেটওয়ার্কের ফোরজি ইন্টারনেট কানেকটিভিটি পুনঃস্থাপন করতে পারবো। বিকেল ৩টার পর থেকে সারা দেশে মোবাইল নেটওয়ার্কের ফোরজি ইন্টারনেট পুনঃস্থাপনের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দেব। তিনি জানান, গত ১৭ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই- এই ১০ দিন সময়ের মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্ক ফোরজি অনেক ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে, ১৭ ও ১৮ জুলাই কিছু কিছু জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার অনুরোধ এবং নির্দেশনা সাপেক্ষে বিটিআরসি ও এনটিএমসি থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করি। নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কিছু কিছু জায়গায় সাময়িকভাবে (বন্ধ করি)। ১৮ জুলাই বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মহাখালীর ত্রাণ পুনবার্সন অধিদপ্তরের নিচতলায় সার্ভার সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও সহিংসতার মধ্যে ১৯ জুলাই মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করে, যা সময়-সময় শিথিল রেখে এখনো বলবৎ রয়েছে। কারফিউর আগেই ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে ফোরজি নেটওয়ার্ক বন্ধ করায় দেশের মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল স্বীকার করেন যে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ১৪৭ জন মারা গেছে। সচিবালয়ে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রী এ কথা জানান। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে। এর পরদিন থেকে এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে গণমাধ্যমে হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করলেও সরকারের তরফ থেকে এই প্রথম মৃতের সংখ্যা জানানো হলো। অবশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক মানুষ মারা গেছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ১৪৭ জনের মৃত্যুর সংবাদ তাঁদের হিসাবে রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্র যারা নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের ছেলেও রয়েছেন। এখানে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার, বিভিন্ন বয়সের মানুষ রয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের মানুষ রয়েছেন। এগুলো পরে বিস্তারিতভাবে দেওয়া যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন হাসপাতাল, বিভিন্ন জেলা এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁরা যে তথ্য পেয়েছেন, তার সংখ্যা এটি (১৪৭ জন)। এই তথ্যটি আজ রোববার পর্যন্ত পাওয়া হিসাব বলে জানান মন্ত্রী। এ বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, আরও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আরও খবর পাওয়া গেলে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এখনো তাঁরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। এরপর যদি মৃত্যুর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায়, তাহলে সংখ্যাটি বাড়তে পারে।
একইদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠে। ভোর ৪টার দিকে আরিফ সোহেলকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আমবাগান এলাকার বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন আরিফের ছোটবোন উম্মে খায়ের ঈদি। আরিফ সোহেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের (৪৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। তিনি তার পরিবারের সঙ্গে আমবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ঈদি বলেন, ঠিক রাত ৩টা ৫০ মিনিটে সাদা পোশাকে ৮ থেকে ১০ জন মানুষ আমাদের বাসার নিচে এসে ডাকাডাকি শুরু করেন। আমার বাবা তাদের পরিচয় জানতে চান। তারা পরিচয়পত্র দেখিয়ে ডিবি পরিচয় দেন। আমরা দরজা খুলতে না চাইলে তারা দরজা ভেঙে ফেলার হুমকি দেন। দরজা খুলে দিলে তারা ভেতরে এসে সবার ফোন নিয়ে নেন। এ সময় তারা ভাইয়ের কম্পিউটার চালু করে কিছু ছবি নেন। পরে আশুলিয়া থানায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আরিফ ও আমার বড় ভাইকে একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। তবে তারা আমার বড় ভাইকে সাভারের গেন্ডা এলাকায় ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে আরিফের খোঁজ পাচ্ছি না।
অভিযোগ অস্বীকার করে ঢাকা উত্তর ডিবি কার্যালয়ের ওসি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, 'জাবি কোটা সংস্কার আন্দোলনের কোনো নেতাকে তুলে আনা হয়নি।