আজ ৩৩ জুলাই (২ আগস্ট) শনিবার ২০২৪ সালের এইদিন শুক্রবার ছিল। সরকার জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করে আরও বেশি আগ্রাসি হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনাসহ ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানা খান কামালের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অনেক বেশি কঠোরতার নির্দেশনা আসে। তারা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে নির্দেশ দিতে থাকেন প্রয়োজনে আরও বেশি লাশ ফেলার জন্য। যে কোন ্উপায়ে আন্দেলন দমন করতে হবে। প্রায় প্রতিদিন এরকমের নির্দেশ পালন করার উৎসাহ দেওয়া হতো। এর ফলো আপ করা হতো প্রতিদিন। নির্দেশ পালন করতে গিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ গোলাবারুদ এবং টিয়ারসেল ব্যবহার করতে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীকে। ঢাকাজুড়ে আন্দোলন দমনের প্রতিটি পদক্ষেপে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে পুলিশ।
আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এদিন দুপুর সোয়া ১২টার পর মোবাইল নেটওয়ার্কে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্যাশ বন্ধ করা হয়। মিডিয়ার খবরে বলা হয়, মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে চেষ্টা করেও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন না গ্রাহকরা। আবার বন্ধ করে দেওয়া হলো মেটার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইনস্টাগ্রাম। তবে এবার মাধ্যমগুলো বন্ধ করা হয়েছে শুধু মোবাইল নেটওয়ার্কে। এছাড়া মোবাইল নেটওয়ার্কে টেলিগ্রাম অ্যাপও বন্ধ করা হয়েছে।
দুপুর সোয়া ১২টার পর মোবাইল নেটওয়ার্কে মেটার প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্যাশ বন্ধ করা হয়। এখন মোবাইল নেটওয়ার্ক থেকে চেষ্টা করেও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছেন না গ্রাহকরা। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা শুরু হলে গত ১৭ জুলাই থেকে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রায় দুই সপ্তাহ পর গত ৩১ জুলাই বেলা ২টার পর থেকে এসব প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়।
আগের দিন বৃহস্পতিবার রাত থেকে দেশে ইন্টারনেটে গতি স্বাভাবিক হচ্ছিল। দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ১২ কোটির বেশি। ফেসবুক মোবাইল ডেটায় বন্ধ থাকলে আবার ভিপিএনের ব্যবহার বাড়বে এবং তা ইন্টারনেটের গতির ওপর প্রভাব ফেলবে।
এতো দিন জামায়াত শিবির পেছনে থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যাক আপ দিলেও ১ আগস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণার পর তারা প্রকাশ্যে রাজপথে নেমে আসে। সমস্ত শক্তি নিয়ে মাঠে নেমে যায় তারা। এ সময় এক সময় চলে আসে যে তারা ডু অর ডাই সিদ্ধান্তে চলে যায়। প্রতিটি জনশক্তি মাঠে নেমে যায় আন্দোলন সফল করার জন্য। সাথে সাথে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠি আলেম সমাজ রাস্তায় নেমে পরে। অন্যদিকে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয় সাধারণ জনগোষ্ঠী। আন্দোলনে রাজপথ পিচ্ছিল হতে থাকে ছাত্রজনতা আর সাধারণ মানুষের রক্তে। সেদিন রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী, ছাত্রলীগ য্বুলীগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় জনতা। শুরু হয় বিপ্লব আর অভ্যূত্থানের প্রসব ব্যাথা।
সেই দিনগুলোয় ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর লড়াইয়ের মাধ্যমে জনগণ একত্রিত হয়, বিশেষ করে বিক্ষোভকারীদের দমানোর জন্য ক্রমবর্ধমান তীব্র ও সহিংস রাষ্ট্রীয় পীড়ন দেখে তারা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে ছাত্র-জনতা। এতে আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
এদিন শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ডাকা ‘দ্রোহযাত্রায়’ যোগ দেন হাজার হাজার মানুষ। যাত্রাটি রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু হয়। পরে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর ও টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী দ্রোহযাত্রায় অংশ নিতে বেলা তিনটার আগে থেকেই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানুষেরা উপস্থিত হতে থাকেন। তাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
যাত্রার শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, তাদের দাবি এখন একটাই, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে আনতে হবে। সরকারের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার নেই। তবে অনেক বিচার বকেয়া রয়েছে। ‘জুলাই হত্যাকাণ্ডের’ বিচার করতে হবে। আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, এখন প্রধান এজেন্ডা (আলোচ্য বিষয়) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে হবে।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দ্রোহযাত্রাটি শুরু হয়। বিকেল সোয়া চারটার দিকে সেটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছায়। দ্রোহযাত্রায় জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সি আর আবরার, আসিফ নজরুল, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ূূূূরাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। শিল্পী সমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ।
২ আগস্ট শুক্রবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মসজিদে জুমার নামায শেষে দোয়া মুনাজাত ও মন্দির, গির্জাসহ সব প্রার্থণালয়ে প্রার্থণার পর নিহতদের কবর জিয়ারত ও ছাত্র-জনতার গণমিছিলের এ কর্মসূচি শুরু হয়। সারা দেশে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এছাড়া এদিন ছিল শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ‘দ্রোহযাত্রা’ কর্মসূচি পালন। শিল্পীসমাজের ব্যতিক্রমী প্রতিবাদে শামিল হন সর্বস্তরের মানুষ।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো হুংকার দিয়ে মাঠে নামে। জামায়াত শিবির এতোদিক পেছনে থেকে আন্দোলনের কল কাঠি নাড়লেও এদিন প্রাদপ্রদীপের সামনে এসে পরে তারা। এতে অংশ নেয় অন্যান্য রাজনৈতিকদলগুলোও।
২ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা হত্যার প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। হাজার হাজার মানুষ বিচারের জন্য মিছিলে যোগ দেয়। রাজধানীসহ সারাদেশে আ’লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের হামলায় আরও দুজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। চলমান সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার ৭৮ এইচএসসি পরীক্ষার্থী সারাদেশের বিভিন্ন আদালত থেকে জামিন পান। তাদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৫৫ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১৪ জন, খুলনা বিভাগের ছয়জন এবং রংপুর বিভাগের তিনজন রয়েছেন। এদিকে, শিশু ও সংস্কৃতি বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা, ইউনিসেফ, জুলাই মাসে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে বিক্ষোভের সময় কমপক্ষে ৩২ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক সঞ্জয় উইজেসেকেরা শিশুরা যাতে আবার স্কুলে ফিরে আসে তা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
ইউনিসেফের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে তিনি বলেন, জুলাই মাসে বিক্ষোভের সময় অন্তত ৩২ শিশু নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হয়েছে ইউনিসেফ। এ ছাড়া অনেক শিশু আহত হয়েছে এবং অনেককে আটক করা হয়েছে। শিশুদের এই মৃত্যু ভয়ানক ক্ষতি। সব ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানায় ইউনিসেফ। বিবৃতিতে ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা জানান, এক সপ্তাহ বাংলাদেশে কাটানোর পর সবেমাত্র দেশটি থেকে গিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও চলমান অস্থিরতার যে প্রভাব শিশুদের ওপর পড়ছে, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
সঞ্জয় উইজেসেকেরা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এবং আটক করা হলে শিশুদের ওপর যে প্রভাব পড়ে, তা নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে ইউনিসেফ শিশুদের যেকোনো ধরনের আটক বন্ধের আহ্বান জানায়। এর অর্থ হলো কোনো স্থানে শিশুদের উপস্থিতি বা তাদের পূর্বের ইতিহাস, ধর্ম এবং তাদের পরিবারের কর্মকাণ্ড বা মতাদর্শের জন্য শিশুদের গ্রেপ্তার বা আটক করা যাবে না।
সহিংসতার প্রভাব থেকে শিশুদের বের করে আনা এবং তাদের নিরাপদে রাখতে স্কুলগুলো খুলে দেওয়া, পড়াশোনা পুনরায় চালু এবং বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের আবার মিলিত হওয়ার সুযোগ তৈরি করা সবচেয়ে ভালো উপায়গুলোর অন্যতম বলে উল্লেখ করেন উইজেসেকেরা। তিনি বলেন, প্রাক্-প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৩ কোটি শিক্ষার্থী ১০ দিন স্কুলে যেতে পারেনি। চলতি বছরের শুরুতে তাপপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছিল, তার সঙ্গে নতুন করে স্কুল বন্ধ হওয়ার ক্ষতি যুক্ত হয়েছে।
ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা বলেন, ৪ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইউনিসেফ। তবে তখনো প্রায় ১ কোটি ৫৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শুরু করতে পারবে না। যত দীর্ঘ সময় শিশুরা, বিশেষ করে কন্যাশিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে, ততই তাদের পড়াশোনায় ফেরার সম্ভাবনা কমবে। এতে তাদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে।
বাংলাদেশ সরকার, ইউনিসেফের অংশীদার এবং তরুণদের জন্য কাজ করছে, এমন সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে বলে বিবৃতিতে জানান সঞ্জয় উইজেসেকেরা। এসব বৈঠকে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে শিশুদের একত্র হওয়া ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টির ওপর জোর দেন তিনি। উইজেসেকেরা বলেন, শিশু ও তরুণেরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তারা যখন কোনো কিছু নিয়ে সোচ্চার হন, তখন তাদের সুরক্ষা দেওয়া উচিত।
এদিন ডিবি হেফাজত থেকে মুক্তি পেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক বলেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকাকালে গত ২৮ জুলাই রাতে এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ঘোষণা তারা দিয়েছিলেন, তা স্বেচ্ছায় দেননি। এক যৌথ বিবৃতিতে ছয় সমন্বয়ক এ কথাগুলো বলেন। বেলা ১১টা ২২ মিনিটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম গণমাধ্যমে এই বিবৃতি পাঠান।
আগের বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টার দিকে ডিবির হেফাজত থেকে ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের ডিবি কার্যালয় থেকে কালো রঙের দুটি গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। পরিবারের কাছে ফেরার পর তারা যৌথ বিবৃতি দিলেন। এ সময় তারা বলেন, ছাত্র-নাগরিক হত্যার বিচার ও আটক নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
‘ডিবি কার্যালয়ে আটক থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কের বিবৃতি’ শীর্ষক এই যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৬ জুলাই ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদারকে ডিবি জোর করে তুলে মিন্টো রোডের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। নাহিদ ও আসিফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরদিন ২৭ জুলাই সারজিস ও হাসনাতকে সায়েন্স ল্যাব এলাকা থেকে জোর করে তুলে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২৮ জুলাই ভোররাতে বাসা ভেঙে জোর করে নুসরাতকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মূলত আন্দোলন ও নেতৃত্বকে ছত্রভঙ্গ করতেই ১৯ জুলাই থেকে সমন্বয়কদের গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তার নামে ছয় সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে জোর করে আটকে রাখা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডিবিপ্রধান নিরাপত্তার কথা বললেও তাদের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যই হেফাজতে রাখা হয়েছিল। তারা গুম, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন থেকে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। তারা তাদের মতপ্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। কিন্তু অসাংবিধানিক ও আইনবহির্ভূতভাবে তাদের ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা হয়। প্রথমে নিরাপত্তার কথা বললেও পরে আদালতের কথা বলা হয়। আদালতের আদেশ ছাড়া নাকি তাদের ছাড়া যাবে না, এমনটা বলা হয়। যাঁরা নিরস্ত্র ছাত্র-নাগরিককে গুলি করে হত্যা করে, তাদের হেফাজতে কেউই নিরাপদে থাকতে পারে না। সরকারের কাছে তারা এই প্রহসনের নিরাপত্তা চান না। তারা তাদের ভাই-বোনদের খুনের বিচার চান।
আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা-সংক্রান্ত ডিবি কার্যালয় থেকে প্রচারিত ছয় সমন্বয়কের ভিডিও বিবৃতিটি তারা স্বেচ্ছায় দেননি বলে যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সিদ্ধান্ত ডিবি কার্যালয় থেকে আসতে পারে না। সারা দেশের সব সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গৃহীত হবে না। ডিবি কার্যালয়ে তাদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করা হয়। তাদের ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিবারকে ডেকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। গণমাধ্যমে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয়। তাদের শিক্ষকেরা দেখা করতে এলে, দেখা করতে দেওয়া হয়নি। অন্যায়ভাবে সমন্বয়কদের আটক, সারা দেশে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ৩০ জুলাই রাত থেকে সমন্বয়ক নাহিদ, আসিফ ও আবু বাকের ডিবি কার্যালয়ে আটক অবস্থায় অনশন শুরু করেন। এ খবর জানামাত্র সারজিস, হাসনাত ও নুসরাতও অনশন শুরু করেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অনশনের কথা পরিবার ও গণমাধ্যমের কাছ থেকে গোপন করা হয়। ৩২ ঘণ্টার বেশি সময় অনশনের পর ডিবিপ্রধান ছয় সমন্বয়ককে মুক্তির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। তখন অনশন ভাঙা হয়। ১ আগস্ট দুপুর দেড়টায় পরিবারের জিম্মায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ডিবি কার্যালয়ে তাদের ও পরিবারের সঙ্গে নানা হয়রানি, নির্যাতন ও নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। তারা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই তাদের অন্যায়ভাবে আটকে রাখা হয়েছিল। সরকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ছাত্র-নাগরিকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সরকার এখনো শিক্ষার্থীদের ওপর দমননীতি অব্যাহত রেখেছে। সারা দেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করছে। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। ছাত্র-নাগরিক হত্যার বিচার ও আটক নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। সারা দেশে ছাত্র-নাগরিকদের প্রতি আহ্বান থাকবে, তারা যেন সরকারের মিথ্যা অপপ্রচার ও দমন-পীড়নকে তোয়াক্কা না করে রাজপথে নেমে আসে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এর ঘোষণা দেয়া হয়। শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবিগুলো হলো-
১) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, দলীয় ক্যাডার ও সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে পদত্যাগ করতে হবে। ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেশে ডিজিটাল ক্রাকডাউন করায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে পদত্যাগ করতে হবে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শহিদ শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে ‘ড্রাগ এডিক্ট’ বলে কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে এবং আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করায় তথ্যপ্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে।
৩) ঢাকাসহ সারাদেশে যত ছাত্র-নাগরিক শহিদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্যাম্পাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি এবং প্রক্টরকে পদত্যাগ করতে হবে।
৫) যে পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং যেসব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের নিরস্ত্র ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে, তাদের আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে হবে।
৬) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ সব লেজুরবৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুততম সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে হবে।
৭) দেশব্যাপী যেসকল ছাত্র-নাগরিক শহিদ এবং আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৮) অবিলম্বে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। সেই সঙ্গে কারফিউ তুলে নিয়ে সারাদেশের সব ক্যাম্পাসে মোতায়েন করা পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াট এবং আর্মি তুলে নিতে হবে।
৯) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। ইতোমধ্যে গণগ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানির শিকার সমন্বয়কবৃন্দ ও ছাত্র-নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।