তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, গত দুই মাস ধরে চাকরির অনিশ্চয়তায় উদ্বিগ্ন, যা সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের মতো উদ্যোগ বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, “আমি জানি না আমার গদি কালকে থাকবে কিনা।” আইনের ১৮টি খসড়া তিনি পেয়েছেন এবং দুই মাস আগে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের পরামর্শ দিয়েছিলেন, কিন্তু এটি এখনও দ্বিতীয় ধাপে আটকে আছে। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বল্প সময়ে এই আইন করা সম্ভব। তিনি মিডিয়া সংস্কারের জন্য বিটিভি ও বেতারকে একীভূত করে স্বায়ত্তশাসিত করার পরিকল্পনার কথা বলেন, কিন্তু কর্মী সমন্বয় ও স্টেকহোল্ডারদের প্রভাবে জটিলতা দেখা দিয়েছে।

গতকাল রোববার সকালে সিরডাপ (সেন্টার অফ ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক) মিলনায়তন সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও অভিযোগ ব্যবস্থাপনাঃ রাজনৈতিক ও নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় অতিথির বক্তব্যে তিনি এইসব কথা বলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন, সেন্টার ফর গভারন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) এর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান, অতিথি হিসেবে ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও দ্য ডেইলি স্টারের উপদেষ্টা সম্পাদক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সাবেক প্রধান কামাল আহমেদ। এ ছাড়াও আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও গণমাধ্যম বিভাগের প্রধান অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এস. এম. শামীম রেজা, বিএনপি মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ডাঃ মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, জি-৯ এর সাধারণ সম্পাদক ডাঃ সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফি রতন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, গণফোরাম সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এবি পার্টির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নাসরিন সুলতানা মিলি, এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) জোবাইরুল হাসান আরিফ, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোঃ রাশেদ খাঁন, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি এম আব্দুল্লাহ্, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক কাজী জেসিন, দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র সাংবাদিক জায়মা ইসলাম প্রমুখ ।

তিনি বলেন, “মন্ত্রণালয়ে দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান স্টেকহোল্ডাররা সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে।” বিজ্ঞাপনের হার বৃদ্ধিতে মিডিয়া হাউজ মালিকরা লাভবান হলেও সাংবাদিকদের প্রকৃত সুবিধা প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, “সাংবাদিকরা আসলে কী পাচ্ছে? মালিকদের কাছে এর উত্তর নেই।” তার সময়ে কোনো মিডিয়া হাউজ বন্ধ হয়নি, তবে ৭২-৭৫ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার সমাধানে তিনি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছেন। নতুন মিডিয়া লাইসেন্স দেওয়া হয়নি বলে তিনি স্পষ্ট করেন। প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সচিবালয় চালাতে সচিব লাগবে, সাধারণ মানুষ দিয়ে মন্ত্রণালয় চলবে না।” তিনি সিভিল-মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি ও কর্পোরেট সমাজের শক্তিশালী নেক্সাসের কথা বলেন, যা ভাঙা কঠিন।

জামায়াতনেতা অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের গণমাধ্যমের সম্মান ও স্বচ্ছতার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা এতটাই জটিল যে গণমাধ্যমকে তার প্রাপ্য সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সমাজে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন এবং সকলের জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে গণমাধ্যমের সম্মান প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। অ্যাডভোকেট জুবায়ের আরও উল্লেখ করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে স্বচ্ছ কার্যপ্রণালী ও সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করা। এটি কেবল বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, বরং বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। তিনি বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রতিশ্রুতি ও স্বচ্ছতা গণমাধ্যমের মর্যাদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হলেও ২০০৭-০৮ সালের ওয়ান ইলেভেনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের প্রতিশ্রুতি পরবর্তীতে বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি উল্লেখ করেন, সংস্কারের বয়ান প্রায়শই প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে, বাস্তবে তা পৃষ্ঠা উল্টে দেখার প্রচেষ্টা কমই দেখা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে পূর্বে বলা হতো, নির্বাচনের আগে সংস্কার অপরিহার্য। বর্তমানে দাবি করা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে সিংহভাগ সংস্কার প্রায় সম্পন্ন। প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক ভাষণে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। দেশকে গণতান্ত্রিক করার জন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই বলে জোর দেওয়া হয়। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসংঘ এবং আর্টিকেল ১৯ এর মতে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের পরিবেশ এখনও নিরাপদ নয়। এই সংস্কার ও গণতন্ত্রের অগ্রগতি নিয়ে সকল পক্ষের সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

কামাল আহমেদ গণমাধ্যমের সুরক্ষা, আইনি সংস্কার ও পেশাদারিত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি ‘সাংবাদিক সুরক্ষা আইন ২০২৫’ ও ‘গণমাধ্যম কমিশন আইন -এর জন্য জনমত সংগ্রহ এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশের সুপারিশ করেন। ছয় মাস আগে রিপোর্ট জমা দেওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিক সুরক্ষা অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি সাংবাদিকদের শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করে তাদের বেতন কাঠামো শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্তি, ওয়েজ বোর্ড সংস্কার এবং বাংলাদেশ বেতার, বিটিভি ও সংবাদ সংস্থাকে এক বোর্ডের অধীনে আনার প্রস্তাব করেন।

এস. এম. শামীম রেজা বলেছেন, গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে, তবে এ বিষয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গবেষণার অভাব রয়েছে। মিডিয়া হাউজগুলো গবেষণায় অনীহা দেখায় এবং ঢাকা-কেন্দ্রিক হওয়ায় আঞ্চলিক পর্যায়ে মনিটরিং ও তত্ত্বাবধানের ঘাটতি রয়েছে।

এম আব্দুল্লাহ্ বলেন যে, ক্ষমতার চাপে সাংবাদিকরা স্বনিয়ন্ত্রণ বা সেলফ-সেন্সরশিপের দিকে ঝুঁকছেন, যা গণমাধ্যমের জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। তিনি সাংবাদিকদের উপর জেল-জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবসময় প্রতিবাদ করে আসছেন। তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ৬১ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। এছাড়া, ৫ আগস্টের পর সাংবাদিকদের উপর হয়রানির ঘটনাও ঘটেছে। এ বিষয়ে তিনি তৎকালীন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং হয়রানিমূলক মামলার সমাধানের জন্য একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই কমিটির মাধ্যমে ৭৮ জন সাংবাদিকের সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করা হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, “২৬৬” সংখ্যাটি ভিত্তিহীন এবং তিনি এর সত্যতা অস্বীকার করেছেন।