পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক লুটপাটের কারণে আর্থিক খাত ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে দেশের সব আর্থিক খাতকে শেষ করে দিয়ে গেছে তারা। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও সেটি উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, গত আওয়ামী সরকারের সর্বগ্রাসী লুটপাটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধান তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কারণে ও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হবে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা শুল্কের কারণে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এ তিনটি চ্যালেঞ্জের কারণে দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি আসবে না। এ অবস্থা থেকে আর্থিক খাতকে পুনরুদ্ধার করতে সরকারকে বেশকিছু সুপারিশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
সূত্র মতে, গত বুধবার রাতে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর বাংলাদেশের দারিদ্র্য হার বাড়তে পারে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চাকরি হারানো ও অর্থনীতিতে ধীরগতি। শুধু দারিদ্র্যই নয়, বাড়তে পারে বৈষম্যও। তবে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাজস্ব সংস্কার এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমাতে ১০টি বিষয় গুরুত্ব দিতে বলেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাটের কারণে আর্থিক খাতের অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। পারিবারিক সম্পর্ক ব্যবহার করে ব্যাংক খাতে লুটপাট করার নজিরও রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২০২৫ সালে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০২২ সালে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা যাদের দৈনিক আয় ২ ডলার ১৫ সেন্টের নিচে ছিল, তার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ হতে পারে। ফলে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা আরও ৩০ লাখ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশে ৯ বছরে উচ্চশিক্ষিত বেকার বেড়েছে ৩ গুণ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিুবিত্ত মানুষকে তাদের আয়ের বড় অংশ দিয়ে নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। ২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ৪ শতাংশ শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছেন। স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ২ শতাংশ এবং উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীদের মজুরি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতের অমিল হলে উত্তেজনা বাড়বে। এ কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝুঁকি কমিয়ে নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে ব্যাংক খাতের নীতি কাঠামো উন্নত করতে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া খেলাপি ঋণ ব্যবস্থাপনায় একটি শক্তিশালী কাঠামো তৈরি প্রয়োজন। আমানত সুরক্ষাব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক পুনর্গঠন, সমন্বিত দেউলিয়া আইন প্রণয়ন, ব্যাংকিং আইন ও নীতির যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা, জরুরি প্রয়োজনে তারল্য সহায়তা দেওয়ার জন্য একটি নীতি কাঠামো তৈরি, ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চাগুলোর অনুশীলন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের আশপাশে থাকবে। ২০২৬ সালে তা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার ঋণের নামে ব্যাংক লুটপাট, বিদেশে অর্থ পাচার এবং রাজনৈতিক প্রকল্পের নামে যে হরিলুট হয়েছে তাতে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকার ঋণ রেখে পালিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার সংকট সামাল দিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও অর্থনীতির রক্তক্ষরণ বন্ধে আওয়ামী লীগ সরকার যেসব উদ্যোগ নিতে পারেনি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেসব উদ্যোগ নিয়েছে। অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব পরিবর্তনের মাধ্যমে সংস্কার ও পরিবর্তনের ফলে কিছুটা আশার আলোও দেখা দিচ্ছে। তবে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে ব্যাংক দখল করে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে সেটি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, গত দেড় দশকে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়েছে। মূলত এতদিন অর্থনীতি যে বিকল অবস্থায় ছিল, তা পুনর্গঠন করে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে অনেক সময় লাগবে। এই সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়স হলে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিয়ে যেসব পূর্বাভাস এসেছে, তার মধ্যে আইএমএফের হলো ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, যা সবচেয়ে কম। আর সবচেয়ে বেশি এডিবির সাড়ে ৪ শতাংশ। আগে প্রবৃদ্ধির হার ফুলেফেঁপে দেখানো হলেও ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অন্তত হয়েছে। এ কারণে চলতি অর্থবছরে যদি ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়, তাহলে তাকে অনেক ভালো বলতে হবে।
বিদায়ী বছরে আর্থিক খাতের পরিস্থিতি নিয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, আর্থিক খাতের দুর্দশা চলমান। ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ বেড়েছে। তারল্য সংকট রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর আর্থিক খাতে নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নেতৃত্ব রক্তক্ষরণ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ফলাফল পেতে সময় লাগবে।
অর্থনীতির দুর্দশা কাটানোর উপায় কী জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, দুটি বিষয় খুবই জরুরি। প্রথমত, খাদ্যপণ্যের উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রধান প্রধান নিত্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, দৈনন্দিন জীবনে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মূল্যস্ফীতি কমাতে না পারলে এবং মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনীতি সচল করা কঠিন হবে।
সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের আমলে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোতে ঋণের নামে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এই টাকার বড় অংশই দলীয় লোকদের দিয়ে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এর প্রভাবে দেশের অর্থনীতি আজ ‘খাদের কিনারায়’। এসব লুটপাট করা অর্থ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা কম। যে কারণে এগুলো খেলাপি হচ্ছে। এতে খেলাপি ঋণ আগামীতে আরও বেড়ে যেতে পারে-এমন আশঙ্কা ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের। সরকার বিশেষ অগ্রাধিকার নিয়ে ১০টি বড় গ্রুপের বিষয়ে বিশদ তদন্ত করছে। এর মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সাইফুর আলম মাসুদের মালিকানাধীন এস আলম গ্রুপ, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খানের ভাই আজিজ খানের মালিকানাধীন সামিট গ্রুপ, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী নজরুল ইসলামের মালিকানাধীন নাসা গ্রুপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন আরামিট গ্রুপ, সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী সিকদার গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ। এই গ্রুপগুলোর মধ্যে কয়েকটির ব্যাংক ঋণ উল্লিখিত খেলাপির তালিকায় রয়েছে। পাশাপাশি বিগত সরকারের সময়ে যারা জালিয়াতি করেছে তাদের বিষয়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, দেশ কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে। মূলত বিগত সরকারের আমলের অনেক পলিসি এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। স্থানীয় মুদ্রায় যা ২৮ লাখ কোটি টাকা। যা গত বছরে দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়ে বেশি। হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর পাচার হয়েছে, ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫ বছরের পাচারের দিয়ে ৭৮টি পদ্মা সেতু করা সম্ভব।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংকিং ও অন্যান্য খাত থেকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। এই অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের লোকজনের লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, ব্যাংকিং খাতে চরম অব্যবস্থাপনা, লাগামহীন দুর্নীতির কারণে দেশের অর্থনীতি ‘ফোকলা’ বা ‘ফাঁপা’ হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে পুরো সম্পদ তারা লুট করে নিয়ে চলে গেছে। সেই সম্পদ বিদেশে নিয়েছে, বাড়ি-ব্যবসা করছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, এই অবৈধ সরকার শুধু রাজনীতিকে নয়, অর্থনীতিকেও পুরোপুরি ধবংস করেছে এবং তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে, প্রতারণা করছে জনগণের সঙ্গে। আন্তর্জাতিক যে সংস্থাগুলো আছে সেই সংস্থাগুলোর সঙ্গেও তারা প্রতারণা করছে।