ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে নারীদের সংরক্ষিত ৫০ আসন ঠিক রেখে সংসদের ৭ শতাংশ আসনে সরাসরি নির্বাচনের জন্য নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার নতুন প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এ প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে দলীয়ভাবে ৩০০ আসনের মধ্যে ৭ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২২তম দিনে সংশোধিত এ প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে ঐকমত্য কমিশন। সংবিধান সংস্কার কমিশন ১০০ আসনে সরাসরি নারীদের নির্বাচনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোটের কথা বলা হয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিও ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীদের ১০০ আসনে সরাসরি ভোটের কথা বলা হয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সরাসরি ভোটের কথা বলে। তবে বাংলাদেশ জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলো সংখ্যানুপাতিক হারে ১০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছে। বিএনপিসহ সমমনারা বিদ্যমান পদ্ধতিতে ১০০ সংরক্ষিত আসনের প্রস্তাব দেয়।

এ অবস্থায় কমিশন ১৪ জুলাই সংশোধিত একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করে কমিশন। সেখানে বলা হয়, কোনো দল ২৫টির বেশি আসনে মনোনয়ন দিলে সেখানে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারী প্রার্থী দেবে। তবে ওইদিন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অধিকাংশ দল। ২৭ জুলাই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দীন আহমেদ বিদ্যমান ৫০ সংরক্ষিত আসন বহাল রাখার পাশাপাশি ৫ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী করার প্রস্তাব করেন, যা আগামী নির্বাচনে বাস্তবায়ন হবে। এরপর চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব দেয় দলটি।

এমন প্রেক্ষাপটে বুধবার বৈঠকে নতুন প্রস্তাব উপস্থাপন করে কমিশন। সেখানে বলা হয়, জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ক্রমান্বয়ে ১০০ আসনে উন্নীত করা হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫ এর দফা (৩) এ প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে বিদ্যমান সংরক্ষিত ৫০টি আসন বহাল রেখে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষরের’ পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ৭ শতাংশ আসনে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। চতুর্দশ জাতীয় নির্বাচনে ১৫ শতাংশ আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো এই হার পর্যায়ক্রমে প্রতি সাধারণ নির্বাচনে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করে সংসদে সরাসরি নির্বাচনে নারীদের মনোনয়নের মাধ্যমে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ১০০ তে উন্নীত করবে। পঞ্চদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো পর্যাপ্ত সংখ্যক নারীদেরকে মনোনয়ন দেবে যাতে ১০০ জন নারী জাতীয় সংসদে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন।

এদিন বেলা ৩টার দিকে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে আরও ছয়টি বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। সেসব বিষয় হল- সরকারি কর্ম কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, ইলেকটোরাল কলেজ ইত্যাদি; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি, এখতিয়ার ইত্যাদি; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব; রাষ্ট্রের মূলনীতি। একটি জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এ আলোচনা এ মাসের মধ্যে শেষ করতে চায় কমিশন। কমিশনের ২০টি প্রস্তাবের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্যে এসেছে রাজনৈতিক দলগুলো। মঙ্গলবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হলেও দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়ে গেছে।

সংস্কার ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার: জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (এনসিসি) দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার ইস্যুগুলোতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছে। আজ বৃহস্পতিবারের মধ্যে এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। গতকাল বুধবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষে তিনি এ কথা বলেন। আলী রীয়াজ বলেন, ‘আপনারা আমাদের যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি বড় দায়িত্ব। আমরা যত দ্রুত সম্ভব এটি চূড়ান্ত করার চেষ্টা করছি। আশা করছি, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) রাজনৈতিক দলগুলোকে সিদ্ধান্তগুলো জানাতে পারব।’

এই পর্যায়ের আলোচনায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি, উচ্চকক্ষ গঠন ও তার সদস্যদের নির্বাচনের প্রক্রিয়া, সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রের মূলনীতি এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিরীক্ষা দপ্তর এবং তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলী রীয়াজ বলেন, ‘সাংসদ হিসেবে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ভালো অগ্রগতি হয়েছে। এ বিষয়ে একটি খসড়া প্রস্তাব আলোচনায় অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি জানান, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সংক্রান্ত আলাদা একটি প্রস্তাবও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে সকল দল মৌলিকভাবে একমত হলেও সংবিধানে এটি কীভাবে প্রতিফলিত হবে—তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। আলী রীয়াজ বলেন, ‘আজকের মধ্যে আমরা যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছি, তার একটি তালিকা দলগুলোকে দেব। আশা করছি, আগামীকাল একটি সমন্বিত এবং গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সবার সামনে উপস্থাপন করতে পারব।