পুলিশের আলোচিত কর্মকর্তা বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারি করেছে আর্ন্তজাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল। গত ১০ এপ্রিল এই নোটিশ জারি করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে গতকাল সোমবার দৈনিক সংগ্রামকে রেড নোটিশ জারির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
সূত্র জানায়, এর আগে শেখ হাসিনা (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী) এবং বেনজির আহমেদ (প্রাক্তন আইজিপি)-এর বিরুদ্ধে রেড নোটিশের আবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল । ইন্টারপোল ইতিমধ্যেই বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করেছে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সাথে বেশ কয়েকটি চিঠিপত্র আদান প্রদান এবং একটি ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। বিষয়টি এখনও ইন্টারপোলের আইনি পর্যালোচনাধীন।
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। বেনজীর আহমেদের ঘটনাটি আর্থিক দুর্নীতি বা অপরাধ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নিলো ইন্টারপোল। বেনজীর এখন কোন দেশে সপরিবারে অবস্থান করছেন, তা জানা সম্ভব হয়নি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলেই ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধান চলাকালে গত বছরের ৪ মে সপরিবারে দেশ ছাড়েন। তিনি ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রেড নোটিশ সরাসরি কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা নয়। তবে এই নোটিশ জারি হলে আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিমানবন্দরে বা ইমিগ্রেশনে (অভিবাসন দপ্তরে) আটক হতে পারেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হয়ে নিজ দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে পারেন।
সূত্র জানায়, বিদেশে পালিয়ে থাকা আসামীদের অবস্থান শনাক্ত করতে ইন্টারপোল সহযোগিতা করে থাকে। অন্যদিকে বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেলে সেটিও সংশ্লিষ্ট দেশ ইন্টারপোলকে জানায়।
ইন্টারপোল যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে, তা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। গতকাল সোমবার বিকেলে ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, মোট ৬ হাজার ৫৮৩ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা আছে। এর মধ্যে ৬২ জন বাংলাদেশি। তবে বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির বিষয়টি তালিকায় নেই। সূত্র জানায়, এই বিষয়টি এখনও তাদের ওয়েব সাইটে পাবলিকলি করা হয়নি। গোপন রাখা হয়েছে। তবে, রেড নোটিশটি ইন্টারপোলের সদস্যভুক্ত ১৯৬ টি দেশের পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে সূত্রের দাবি। সূত্র মতে, বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশটি জারির পর ইন্টারপোল থেকে বাংলাদেশ পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়।
এর আগে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়। বিদেশে পলাতক ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন করে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। শেখ হাসিনাসহ যাদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে, তারা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। ওবায়দুল কাদেরসহ ১০ জন গত ৫ আগস্টের আগে-পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এর মধ্যে সাবেক মেয়র তাপস দেশ ছাড়েন ৩ আগস্ট।
বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, আদালত, প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে। শেখ হাসিনাসহ যে ১২ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে আর্থিক অপরাধের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অন্যদের বিরুদ্ধে করা আবেদনে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-উপাত্ত যুক্ত করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা ও বেনজীর আহমেদ ছাড়া অন্য ১০ জনের বিরুদ্ধে এনসিবি থেকে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয় ১০ এপ্রিল। এর আগে তাদের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে নথিপত্রসহ চিঠি পাঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।
শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করতে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করতে গত বছরের নবেম্বরে পুলিশ সদর দপ্তরকে অনুরোধ করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়।
তবে ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদনের বাইরে ভারতসহ যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, সে চুক্তির আওতায় বিদেশে পলাতক ব্যক্তিদের ফেরানোর চেষ্টাও রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।