এমন একজন মানুষ পাওয়া গেলো যিনি জুলাই আন্দোলনে নিজের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শরিক হয়েছেন। ৪ঠা আগস্ট যাত্রাবাড়িতে পুলিশের গুলীতে হতাহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেই মাথায় গুলীবিদ্ধ হন। তার নাম মো: ইব্রাহীম সরকার। পেশায় গাড়িচালক হলেও তার আন্দোলনের অংশগ্রহণটা ছিল ভিন্ন রকমের। তার আন্দোলনের ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামের কাছে। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনারাতো আম জনতা। কখন থেকে বুঝতে পারলেন যে আপনাদেরও আন্দোলন করা দরকার ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : যখনই দেখলাম সরকার তার বাহিনী দিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মারধর করছে। এরপর আবু সাঈদকে হত্যা করলো। চট্টগ্রামেও মারা গেল তখনই মনে হলো আমাদের আন্দোলনে নামা দরকার। ছাত্ররাতো আমাদের সন্তানের মতো। তারাতো তাদের ভবিষৎ নিয়ে কথা বলতেছে। তারাতো কোন অন্যায় করেনি। তারা তাদের দাবি আদায়ে যখন কমপ্লিট সাট ডাউন কর্মসূচি দিলো তখন থেকেই আমরা আন্দোলনে যোগ দিলাম। ১৬ জুলাই যখন আবু সাঈদকে হত্যা করলো তখন কেবল আমি না সব জনগণ সরকারের প্রতি ক্ষেপে গেল।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনি কোন এলাকাতে আন্দোলনে ছিলেন ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : আমি মূলত রায়েরবাগ থেকে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত এলাকাতে আন্দোলন করেছি। ছাত্রররা রাস্তায় বসে গোল হয়ে যখন বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল, তখন আমরাও তাদের সাথে বসে স্লোগান দেই। তখন ছাত্ররা খুব খুশি হতো এজন্য যে তাদের আন্দোলনে সবাই যোগ দিচ্ছে। তারা বলতো মুরব্বিরা আমাদের সাথে আছে। আমাদের গার্ডিয়ান সাথে আছে। তারা আমাকে খুব সম্মান করতো। আমিও তাদের সাথে আন্দোলন যোগ দিয়ে আনন্দ পেতাম। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে তাদের খাবার কিনে দিতাম।

দৈনিক সংগ্রাম : কত তারিখ থেকে আপনাদের আন্দোলন শুরু হলো ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : ১৭ তারিখ থেকে ছাত্রদের সাথে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। আমিও তাদের সাথে প্রতিদিন ছিলাম। আমি আগস্টের তারিখ গুলীবিদ্ধ হই।

দৈনিক সংগ্রাম : আন্দোলনের দুই একটা দৃশ্যপট যদি বলেন।

মো: ইব্রাহীম সরকার : কমপ্লিট সাটডাউনের সাথে সাথে কেবল আমি না আরও অনেক লোক ছাত্রদের সাথে যোগ দেয়। ছাত্ররা যেমন আমাদের সম্মান করেছে; আমরাও তাদের সম্মান দেখিয়েছি। সে কারণেই আমি আমার পকেটের টাকা খরচ করে সামর্থ অনুযায়ী তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেছি।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনিতো চাকরি করতেন। আন্দোলনে কখন সময় দিতেন ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : আমি যেহেতু ড্র্রাইভিং পেশায় আছি। ঐ সময়টায় আমার কাজ বন্ধ ছিল। এজন্য পুরো সময়টা আন্দোলনে কাটিয়েছি। আমি ফজর পড়ে বের হতাম আর এশার নামায পড়ে বাসায় ফিরতাম। পরিবার সব সময় টেনশনে থাকতো যে কখন আবার কি হয়ে যাই। আমি বলতাম ভবিষৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে রাস্তায় থাকতে হবে। একথা বলার পর আমার পরিবারের সদস্যরাও আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নেয়।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনার পরিবারের আর কে কে আন্দোলনে নামলো।

মো: ইব্রাহীম সরকার : আমার মেয়ে আমার ছেলে এবং আমার স্ত্রী। তারা আমার সাথে যোগ দিলো ১৯ জুলাই থেকে।

দৈনিক সংগ্রাম : ১৯ তারিখতো ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। তখন আপনারা আন্দোলনটা কিভাবে করছিলেন ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : পুলিশ র‌্যাব বিজিবি যখন এপিসি কার নিয়ে যেতো তখনও আমরা রাস্তায় ছিলাম। আমরা ছিলাম ধনিয়া কলেজ এবং শনির আখড়া আন্ডারপাসের কাছে।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনাদের মধ্যে যোগাযোগটা কিভাবে হতো ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : আমরা যেহেতু স্বউদ্যোগে প্রতিদিন নামতাম। আমাদের কারো সাথে যোগাযোগ করা দরকার হতো না। প্রতিদিনতো শনির আখড়াতে আন্দোলন হতো। আমরা সব সময় ছিলাম। সকাল থেকে সনধ্যা পর্যন্ত। আমাদের সুবিধা ছিল আমরা ফ্যামেলির লোক। যখনই সন্দেহ করতো তখন আমরা পরিবার রাস্তায় বের হয়েছি বলে পরিচয় দিতাম।

দৈনিক সংগ্রাম : ৪ তারিখতো গুলীবিদ্ধ হয়েছেন। সেদিনের দৃশ্যটা যদি একটু বলেন।

মো: ইব্রাহীম সরকার : ৪ তারিখে ফজরের নামায পড়ে আমি রাস্তায় আসি। তখন রাস্তায় ব্যাপক জনতার উপস্থিতি দেখি। যেহেতু ধারাবাহিকভাবে রাস্তায় ছিলাম; তাই ছাত্রদের দিক নির্দেশনা কি ছিল সেটা মাথায় রাখতাম। আর অচেনা অজানা থাকলেও ছাত্রদের সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল। সকালেই শুনি যে সেখানে বেশ হতাহত হয়েছে। প্রথম আমরা কদমতলী থানায় গিয়েছিলাম। তখন আমরা বিশ^রোড থেকে ভেতরে ঢুকার সাহস পাইনি। দেখলাম যারাই ভেতরে গেছে তাদের আহত অবস্থায় রিকশা ভ্যানে করে আনতেছে। এরপর শুনলাম যাত্রাবাড়িতেও একই অবস্থা। তখন আমরা যাত্রাবাড়ির দিকে গেলাম। আমরা থানার সামনে এসে দেখলাম প্রচুর লোক সমাগম। যোহরের নামাজের পরের কথা বলছি। পুরো রাস্তাজুড়ে মানুষ আর মানুষ। আমরা স্লোগান দিতে দিতে থানার সামনে এসে থামি। আমি যাত্রাবাড়ি গেইট বরাবর ডিভাইডারের মাঝামাঝি ছিলাম। এসময়-ই ব্যাপক গুলী শুরু হলো। এই অবস্থায় সামনের দিকে যারা ছিলেন, পেছনের দিকে দৌড়ে আসতে লাগলো। আমি যেহেতু মাঝখানে ছিলাম, তাদের ধাক্কায় আমিসহ কয়েকজন পরে যাই।

দৈনিক সংগ্রাম : তখন আপনার স্ত্রী ছেলে মেয়ে কই ছিল?

মো: ইব্রাহীম সরকার : তারা একটু দূরে ছিল। আমি যখন পড়ে গেলাম তখন আমার উপর দিয়ে অনেকে চলে গেলেন। আমি রাস্তায় শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর গুলী আওয়াজ কমে যায়। আমি দেখলাম গুলীতে অনেক মানুষ হতাহত। শিশু মধ্য বয়সী সব বয়সের মানুষ আহত হয়ে কাতরাচ্ছে। আমি উঠলাম তখন। মনে মনে ভাবলাম এই আহতদের রেখে আমি যাই কি করে। আমি তাদের উদ্ধার করতে লাগলাম। গুলীবিদ্ধ হয়েও তারা কথা বলতেছিল। কাঁদতেছিল। সাহায্য চাচ্ছিল। আমি যখন ওঠে ৫ থেকে ৭ কদম এগোলাম তখন দেখি আবার গুলী করছে পুলিশ। তখনই আমি মাথায় গুলীবিদ্ধ হলাম। পায়েও গুলী লাগলো। আমার কাঁধে তখন আহত দুইটা বাচ্চা। আমার গায়ে গুলী লাগার পর আমি প্রচ- ব্যাথা অনুভব করছি। শরীরে জ¦ালপোড়া শুরু হয়ে গেছে। ততক্ষণে আমি ২০/২৫ গজ এসে গেছি। তখন দেখি অনেক মানুষ সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেছে উদ্ধারের জন্য। তারা বললো আপনি তাদের ছাড়েন। আমরা তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তখন আমি আমার পরিবারের লোকজনকে খোজতে থাকলাম।

দৈনিক সংগ্রাম : আপনার এতোক্ষণে হুঁশ হয়েছে যে আমার পরিবারের লোকগুলো কোথায় ?

মো: ইব্রাহীম সরকার : তারা তখন যাত্রাবাড়ি মাছের আড়তের কাছে ছিল। আমি দৌড়ে পরিবারের কাছে যাই। তাদের বললাম যে, আমার মাথা এবং শরীর প্রচন্ড ব্যাথা করছে। তারা দেখলো পেছন দিকে শার্ট ছিদ্র হয়ে গুলী ঢুকেছে। আমি বাচ্চার মাকে বললাম আমার মাথা এবং ঘাড়ে যন্ত্রণা হচ্ছে, তখন বাচ্চার মা বলছে যে তোমার তো মাথা থেকে অনেক রক্ত ঝরছে। কাছা কাছি একটা ভ্যানগাড়ি ছিল ডাক দিলাম। তখন ওই গাড়ি ওয়ালা আমাদের নিয়ে হাসপাতালের দিকে ছুটলো। সেদিন ভ্যানগাড়ি ওয়ালা আমাদের কাছ থেকে কোন ভাড়া নিলো না।