সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ-সিজিএস’র আয়োজিত পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ” শীর্ষক আলোচনায় দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকরা বলেন, স্বৈরাচার হাসিনার সময়ে পররাষ্ট্রনীতি কার্যকর ছিলনা। পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনা ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত কেন্দ্রীক পররাষ্ট্রনীতি চালু করে ছিল। বিএনপি-জামায়াত মতো বড় দলগুলোকে আগামী দিনে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো প্রকাশ করার দরকার। সরকার প্রধান যে নির্দেশনা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেভাবে কাজ করে। চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা করার নিয়ম থাকলেও করা হয় না। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী দূতাবাস গুলো কাজ করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান মধ্যদিয়ে নতুন আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, সেই অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতি সংস্কার করার দরকার।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সিরডাপ (সেন্টার অন ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক) মিলনায়তনে সিজিএস আয়োজিত ‘পররাষ্ট্রনীতি’ বিষয়ক সংলাপে বক্তারা এইসব কথা বলেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউটের সভাপতি এম্বাসেডর হুমায়ুন কবির; নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত); বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন; এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু; সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী; জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী; বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন; সেন্টার ফর গভার্ন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী; সাবেক কূটনৈতিক এম শফিউল্লাহ; বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ ইন্টার্ন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান এম্বাসেডর মুন্সি ফয়েজ আহমেদ; মায়ানমার-এর সাবেক কনস্যুলেট প্রধান ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর মোঃ এমদাদুল ইসলাম (অব.); কূটনীতিক শহীদুল ইসলাম; নৈতিক সমাজ বাংলাদেশের সংগঠক মেজর জেনারেল (অবঃ) আমসা আমিন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ; ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ; বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সিনিয়র গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির; সেন্টার ফর নন রেসিডেন্ট বাংলাদেশিজের চেয়ারম্যান এম এস সেকিল চৌধুরী; গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি; গণঅধিকার পরিষদ (জিওপি) এর সভাপতি নুরুল হক নুর; এবি পার্টি’র সহকারী সদস্যসচিব ও উইমেন উইং এর কে-অর্ডিনেটর ব্যারিস্টার নাসরীন সুলতানা মিলি প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর গভার্ন্যান্স স্টাডিজ এর সভাপতি জিল্লুর রহমান।

সংলাপের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, পররাষ্ট্রনীতি আমাদের নিরাপত্তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত পনেরো বছর আমদের সাথে পাকিস্তানের ভাল সম্পর্ক ছিল না। ভারতের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ এখন এমন হয়েছে যে হয় তাদের নীতি হল আপনারা আমাদের সাথে থাকবেন নাহলে চীনের সাথে থাকবেন। আমাদের অর্থনীতির অবস্থা ভাল হয়। বেকারত্ব হার বেড়েছে এবং মানবাধিকার অবস্থাও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক আমাদের এখনো টানাপোড়নে আছে। চীন ও ভারতের সাথে ব্যালেন্স করাটাও অনেক জরুরি।

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, বাংলাদেশ মূলত আমদানি নির্ভর অর্থনীতি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার সুত্র হল রেমিটেন্স ও আরএমজি। আমরা রপ্তানি আমেরিকা ও ইউরোপে বেশি করে থাকি। নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যে সরকার আসবে তারা তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তার আলোকে পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়ন করবে। পররাষ্ট্র নীতিতে জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও সাইবার সিকিউরিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের দেশকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। বৈশ্বিক রিমোট কন্ট্রোল কার হাতে রোহিঙ্গাদের বার্মা থেকে সরিয়ে দিয়েছে কারা তা জানতে হবে। আমদানি নির্ভর অর্থনীতি নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের ঋণ নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, বর্তমানে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ। রিজার্ভ বাড়া কৃতিত্বের কিছু না কারণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি রফতানি বাড়াতে কাজ হচ্ছে না। চীন যদি গঙ্গার পানির উৎপত্তি স্থল বন্ধ করে দেয় তবে বুঝতে হবে ফারাক্কা বাধ কতা ক্ষতিকর ছিল আমাদের জন্য। সার্ক ছাড়া আর বিকল্প নেই আমাদের জন্য। আঞ্চলিক সম্পর্ক গভীর করার জন্য সার্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পারভেজ কারিম আব্বাসী বলেন, পলাকত স্বৈরাচার হাসিনার সময়ে পররাষ্ট্রনীতি কার্যকর ছিলনা। সে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারত কেন্দ্রীক পররাষ্ট্র নীতি চালু করে ছিল। বিএনপি জামায়াত মতো বড় দলগুলোকে আগামী পররাষ্ট্র নীতি নিতে কাজ করতে হবে।

রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো প্রকাশ করার দরকার। সরকার প্রধান যে নির্দেশনা দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেভাবে কাজ করে। চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা করার নিয়ম থাকলেও করা হয় না। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী দূতাবাস গুলো কাজ করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান মধ্যদিয়ে নতুন আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। তা বিশ্বে উপস্থাপন করতে পারিনি। ভারতের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে। নেপালের সংবিধান তৈরি সময় ভারত জানতে পারেনি। বাংলাদেশ একটা গণমানুষের দেশ এই মানুষের শক্তিকে ঐক্য বদ্ধ করে কাজে লাগাতে হবে। বাংলাদেশ অনেক সংস্কার হয়েছে কিন্তু গত ৫৩ বছরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোনো সংস্কার হয়নি। দুটো সংশোধন হয় একটি এরশাদের সময় অন্যটি হচ্ছে মুর্শেদ খানের সময় যা বাস্তবায়ন হয়নি। আমার জ্বালানি আমদানি নির্ভর অর্থনীতি। রেমিট্যান্স ও পোশাক রফতানি ক্ষেত্রে আরও দক্ষ শ্রমিক তৈরি করতে হবে। দেশে আইনের শাসন না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না।

মেজর অব. আমসা আমিন বলেন, বাংলাদেশে ফরেন পলিসিতে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ নাই, সিআই মোসাদের মতো। এইজন্য অনেক পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এই সরকার জুলাই নিয়ে বই বানিয়েছেন আর উপহার দিচ্ছে।

মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান (অবসরপ্রাপ্ত) বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আচরণ গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদের পক্ষে ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের সরিয়ে দিতে হবে এবং গণহত্যার অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিপ্লবের যেই আকাঙ্খা ছিল তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিফলিত হয় নাই। ফ্যাসিজম একটা ইকোসিস্টেম। পুনর্গঠন করতে হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ফ্যাসিবাদের দোসরদেরকে সরাতে হবে। ফরেন পলিসিতে প্রাইভেট সেক্টরকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কেবল আমলা দিয়ে হবে না। আমাদেরকে ক্লাইমেট ডিপ্লোম্যাসি নিয়ে আমাদেরকে কাজ শুরু করতে হবে। প্রবাসীদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য দূতাবাসগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। সার্ককে আবার পুনর্জীবিত করতে হবে। হিউমান রাইটস ডিফেন্ডার হতে হবে। আমাদের সামুদ্রিক নীতিমালা নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে এবং এটি বাইরের দেশের কাছে জানাতে হবে। পানি ও নদী কূটনীতি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পানি বণ্টন নিয়ে আমরা নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে চলেছে। সাইবার সিকিউরিটিতে আমাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। টেকনোলোজির ব্যাপারে নতুন করে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সব দেশের সাথে তাল মিলিয়ে আমারা কীভাবে চলতে পারি তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

রাষ্ট্রদূত শহিদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত না ফরেন পলিসি সক্ষমতা দেখাতে পারবো তবে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সমস্যার সমাধান হবে না। বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার সাথে যতগুলো গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা প্রকাশ করা।

মাহাদী আমিন বলেন, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার সময়ে মতামতের মাধ্যমে সিধান্ত নেওয়া হত। আমাদেরকে এখন মতামতের মাধ্যমে সিধান্ত নিতে হবে। ম্যারিটাইম সিকিউরিটি শক্ত করতে হবে। আইটি সিকিউরিটিও শক্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে ডিগ্নিফাইড ভাবে রিপ্যাট্রিয়াট করতে হবে। পানি সংকট সমাধানের জন্য বাইল্যাটেরাল ও মাল্টিল্যাটারাল নেগসিয়েশন করতে হবে।

এম শফিউল্লাহ বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাকে তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হবে পররাষ্ট্র নীতির জন্য। রাজনৈতিক দলের ইন্টারফেয়ার করা উচিত না। ন্যাশনাল কন্সেন্সাস অন ফরেন পলিসিতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের একমত হতে হবে। এটি না হলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কাজও পরিবর্তন হয়ে যায়। এতে ডিপ্লোম্যাটসদের অনেক সমস্যা ফেস করতে হয়। রাজনীতিবিদদের কাছে অনুরোধ যে আপানারা আপনাদের অভ্যন্তরীণ পলিটিক্স দেশের মধ্যে রাখেন। এইটা বাইরে নিবেন না

মেজর মোঃ এমদাদুল ইসলাম (অব.) বলেন, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ রিপোর্ট অনুসারে আমাদেরকে আরাকান আর্মির সাথে যোগাযোগ করতে। আরাকান আর্মির সাথে শিঘ্রই রোহিঙ্গাদের একটা সংঘাত হবে যা বাংলাদেশের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করবে।

ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, আমাদেরকে ট্রাক টু ডিপ্লম্যাসি করতে হবে। ‘ফ্রেন্ডশীপ টু অল, ম্যালিস টু নান’ হয়ে গিয়েছে ফ্রেন্ডশীপ টু ওয়ান। আমেরিকা আগে আমাদেরকে বলেছিল ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক নরমাল করতে। এখন নন-ডিস্ক্লোসারের মধ্যে এটি চলে আসতে পারে। তখন আমাদের কিছু করার থাকবে না।