নবেম্বরের মধ্যে গণভোট, উভয়কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনরত আটটি দল আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি দিবে। গতকাল বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে আন্দোলনরত দলসমূহের ব্যানারে আট দলের নেতারা এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনূস আহমদ। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার নিকট জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা জমা দিয়েছেন। তারা বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে সরকারকে তিনভাগে সুপারিশ করেছেন। এই সুপারিশের মধ্যে যে সকল বিষয় সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয় তা সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে করতে পারে। সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয় ও জুলাই জাতীয় সনদ সংক্রান্ত সরকার একটি আদেশ জারির পর জনগণের ম্যান্ডেন্ট নেওয়ার জন্য গণভোট হবে।

তিনি বলেন, আমরা আন্দোলনরত দলসমূহ জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন, আগামী নভেম্বরে গণভোট আয়োজন ও ফেব্রুয়ারি-২০২৬ এ সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে পাঁচদফা দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন করে আসছি। আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে আগামী ৩০ অক্টোবর আজ নির্বাচন কমিশনে স্মারকলিপি প্রদান ও তিন নভেম্বর শীর্ষ নেতাদের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আজ আমরা আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। বর্তমানে বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের সফল গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাষ্ট্রের প্রয়োজনকে সামনে রেখে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে গণহত্যার বিচার, রাষ্ট্র সংস্কার ও স্বৈরাচার ফিরে আসার সকল পথ রুদ্ধ করার প্রত্যয় নিয়ে কাজ শুরু করেন। গঠিত হয় বিভিন্ন সংস্কার কমিশন। কমিশনগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে আলোচনায় মিলিত হন। দীর্ঘ আলোচনার পর ৮৪টি প্রস্তাব সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়। অনেকগুলো প্রস্তাবের সাথে দু/একটি রাজনৈতিক দল ভিন্নমত পোষণ করায় অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।

সাংবাদিক সম্মেলনে বলা হয়, ইতোমধ্যেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার নিকট জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা জমা দিয়েছেন। বাস্তবায়নের উপায় হিসেবে সরকারকে তিনভাগে সুপারিশ করেছে ঐকমত্য কমিশন। এই সুপারিশের মধ্যে যে সকল বিষয় সংবিধান সংশ্লিষ্ট নয়- তা সরকার অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে করতে পারে। সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয় ও জুলাই জাতীয় সনদ সংক্রান্ত সরকার একটি আদেশ জারির পর জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়ার জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোট ব্যতীত জুলাই জাতীয় সনদ আইনগত টেকসই ভিত্তি পাবে না। গণভোটের বিষয়ে সকলেই একমত হয়েছেন। আমরা মনে করি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে নভেম্বর মাসের মধ্যে গণভোট সম্পন্ন করতে হবে।

লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ভয়ভীতিমুক্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়ে আসছি। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ, ভোটকেন্দ্র দখল, পেশিশক্তি প্রদর্শন ও ভোটের বিভিন্ন অনিয়ম ও অপতৎপরতা বন্ধ, কোয়ালিটি-সম্পন্ন পার্লামেন্ট এবং দক্ষ আইনপ্রণেতা তৈরিসহ প্রতিটি ভোট মূল্যায়নের লক্ষ্যে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছি। বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবির সাথে একমত পোষণ করেছেন।

লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। ইতোমধ্যে উপদেষ্টা পরিষদ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনীর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমরা লক্ষ্য করছি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কিছু বিষয় পরিবর্তনের জন্য একটি রাজনৈতিক দল দাবি জানিয়েছে। এ দাবি কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ করার সুযোগ নেই।

এদিকে প্রশ্ন উত্তর পর্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন অথবা আগে গণভোট দেওয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তারিখ না বলে ঐকমত্য কমিশন যে জটিলতা তৈরী করেছেন তার ফলে গণভোট দিতে যত দেরি হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তত সংকট ও সংশয় তৈরী হবে। এখন জাতিকে এই সংকট থেকে মুক্ত করতে পারেন প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশন যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে সেখানে ওনারা (গণভোট কখন হবে) সে বিষয়ে কনক্রিট কোনো কথা বলেননি। তারা বলেছেন জাতীয় নির্বাচনের দিনে অথবা তার আগে যেকোনো সময়। তার মানে উনারা ঝুলিয়ে রেখেছেন। এটা বলাতে একটা ক্রিটিকাল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। এখন বল চলে গেছে সরকারের কোটে। সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের সবগুলো দলের পরিস্কার বক্তব্য যে এই ঐকমত্য কমিশন যদি সুনির্দিষ্ট করে জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে নভেম্বরে গণভোটের তারিখটা বলে দিতেন তাহলে জিনিসটা ঝামেলা হতো না।

তিনি বলেন, এখন দুই/একটা দল যারা একই দিনে গণভোট আর জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছেন এতে তারাও যেমন কথা বলার সুযোগ পেলেন, আর আমরা যারা আগে গণভোট চাচ্ছি আমরাও সুযোগ পেয়েছি। মাঝখান দিয়ে ঐকমত্য কমিশন বেঁচে গেছে।

জামায়াত সেক্রেটারি বলেন, আমরা আজকে বলতে চাই সরকারের এখন দায়িত্ব পড়ে গেছে গণভোটের তারিখ ঘোষণা করা। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট দেওয়ার তারিখ যদি ঘোষণা করা না হয় তাহলে যত দেরি করা হবে ততই কিন্তু মূল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিয়ে নতুন সংকট দেখা দেবে। জটিলতা এড়াবার জন্য আমরা সমমনা আটটি দল অবিলম্বে প্রধান উপদেষ্টা তিনি যেমন সরকারেরও প্রধান, তিনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনেরও প্রধান। দুই জায়গার প্রধান হওয়ার কারণে ওনার দায়িত্ব হয়ে পড়েছে জাতিকে এই সংকট সংশয় মুক্ত করা। রাজনীতির আকাশে যে মেঘ জমেছে এই মেঘটাকে দূর করে একটা আলোর নিশানা তিনিই দিতে পারেন। সেটা নভেম্বরের মধ্যেই গণভোটের তারিখ দিতে হবে। আর যে জুলাই সনদের ব্যাপারে আমরা ঐকমত্য হয়েছি সেই আদেশ জারি করতে হবে। যত দেরি হবে তত কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের মূল তারিখ সংকটের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা আছে।

ঐকমত্য কমিশন নিন্মকক্ষের পিআর নিয়ে কোনো প্রস্তাব দেয়নি। তারা উচ্চকক্ষে পিআর বাস্তবায়নের কথা বলেছে। কিন্তু জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন উভয় কক্ষে পিআর চায়। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে গোলাম পরওয়ার বলেন, আমাদের মধ্যে যে দলগুলো আছে তারা কেউ উচ্চকক্ষে পিআর চায়, আর জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চায়। আমরা আমাদের দাবিতে অটল আছি। এ দাবির পক্ষে আন্দোলন চলবে

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ, ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ ইউনূস আহমদ, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমেদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা ইউসুফ আশরাফ, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইযহার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, জাগপার সহসভাপতি ও মূখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির মহাসচিব নিজামুল হক নাঈম প্রমুখ।