পুলিশের সদর দফতর থেকে মাঠ পর্যায়ের ২২টি শাখার শাখা প্রধানের পদবী এডিশনাল আইজিপি (অতিরিক্ত মহা পুলিশ পরিদর্শক)। এই ২২টি এডিশনাল আইজিপির বাইরেও রয়েছে সুপার নিউমারীর ৭টি এডিশনাল আইজিপির পদ। সব মিলে পুলিশে বর্তমানে এডিশনাল আইজিপির পদ ২৯টি। দায়িত্বে আছেন মাত্র ৯জন। বাকী পদগুলো শূণ্য নিয়েই চলছে পুলিশের কার্যক্রম। তবে, শূণ্য পদগুলোতে ডিআইজি (উপ-মহা পুলিশ পরিদর্শক) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের দিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর নানা কারণে পদগুলো শূণ্য হয়ে যায়। কেউ স্বাভাবিক অবসরে গেছেন, কেউ গেছেন বাধ্যতামূলক অবসরে। আবার কেউ হয়েছেন কৃতকর্মের জন্য পলাতক। এ অবস্থায় পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলো পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রথমত: পুলিশের এডিশনাল আইজিপির শূণ্য পদগুলোতে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বাকী শূণ্য পদগুলোতেও পদোন্নতি দিয়ে পূরণ করা হবে। দীর্ঘদিনের বঞ্চিতরাই শূণ্য পদগুলোতে পদোন্নতি পাচ্ছেন বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা গেছে।

এদিকে, পুলিশ সুপার (এসপি) ও সম পদমর্যাদার পদ থেকে ডিআইজি পর্যায়ের পুলিশ প্রশাসনের তিন স্তরেও হচ্ছে বড় ধরনের রদবদল। এই রদবদলের মাধ্যমে আজ-কালের মধ্যেই নতুন করে সাজানো হবে পুলিশের মাঠ পর্যায় থেকে সদর দফতর পর্যন্ত। এসব স্তরে কর্মরতদের নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ফলে রদবদলের বিকল্প দেখছে না সরকার। রেঞ্জ ডিআইজির পদেও রদবদল হচ্ছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা রেঞ্জের দায়িত্বে আসছেন ডিএমপির ডিবি প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া রেজাউল করিম মল্লিক।

পদোন্নতি পাচ্ছেন ১৯ ডিআইজি

১২ তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশে নিয়োগ পেয়েছিলেন গোলাম রসুল (এএসপি)। তিনি নিয়োগ পাওয়া ৩০ জনের একজন। তার সাথের অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে এডিশনাল আইজিপি হয়েছেন। অবসরেও গেছেন। আবার কেউ আওয়ামী লীগ সরকারের রোষাণলেও পড়েছেন, চাকরি হারিয়েছেন। কেউ হয়েছেন ওএসডি। গোলাম রসুল বঞ্চিতদের শীর্ষে। বর্তমানে কর্মরত পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান হিসেবে। পরবর্তী ১৫তম বিসিএসের মাধ্যমে পুলিশের এএসপি পদে নিয়োগ পান ১১৬জন। তাদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক আনুকুল্য পেয়ে এডিশনাল আইজিপিও হয়েছেন। সিনিয়রদের ডিঙ্গিয়ে জুনিয়রদের বসানো হয় সুবিধাজনক পদে। বঞ্চিতরা গত ১৫ বছর এসব অনিয়ম দেখেছেন চরম হতাশা নিয়েই। বর্তমান সরকার পুলিশ প্রশাসনের সকল অনিয়ম ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হতাশা দূর করতেই ধাপে ধাপে পদোন্নতির উদ্যোগ নেয়। এবার ১৯জন ডিআইজিকে পদোন্নতি দিয়ে এডিশনাল আইজিপি করা হচ্ছে। তারা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।

জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন পদে পদোন্নতির জন্য সাতজন সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। এই বোর্ডের মাধ্যমেই এখন চূড়ান্ত করা হচ্ছে ১৯ ডিআইজির পদোন্নতির বিষয়টি। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দফতর থেকে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তালিকা যাচাই বাছাই করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসএসবিতে পাঠানো হয়েছে। বোর্ডের পদোন্নতির সুপারিশের ভিত্তিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এডিশনাল আইজিপি পদে পদোন্নতির আদেশ জারী করবে।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে এসবি প্রধান গোলাম রসুল রয়েছেন এডিশনাল আইজিপি পদে পদোন্নতি তালিকার শীর্ষে। এরপর আলোচনায় রয়েছেন, ১৫তম বিসিএসের একেএম আওলাদ হোসেন, মো: আকরাম হোসেন, হাসিব আজিজ, গাজী জসিম উদ্দিন, আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ, খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, মোসলেহ উদ্দিন আহমদ, মো: ছিবগাত উল্লাহ, মো: আলী হোসেন ফকির, ব্যারিস্টার মো: জিল্লুর রহমান, শাহ আবু সালেহ মো: গোলাম মাহমুদ, মো: সরওয়ার, সরদার নুরুল আমিন, মো: মোস্তফা কামাল, কাজী মো: ফজলুল করিম, ড. মো: আক্কাছ উদ্দিন ভুঞাঁ, মো: আহসান হাবীব পলাশ, ড. মো: নাজমুল করিম খান, মো: নজরুল ইসলাম, তানভীর হায়দার চৌধুরী, মো: মাইনুল হাসান।

অন্যান্য যতো পদ ফাঁকা

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি, পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপারের ৩৪৭টি পদ এখন শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৫২টি ডিআইজি পদের (মঞ্জুরীকৃত পদ ৮৭ ও সুপারনিউমারারি ৬৫) মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছেন ১৩৪ জন। ডিআইজির নিয়মিত ১৫টি পদ এবং সুপারনিউমারারি ৩টি পদ শূন্য রয়েছে। অতিরিক্ত ডিআইজির পদ রয়েছে ৩৪১টি (মঞ্জুরীকৃত ২০১টি ও সুপারনিউমারারি ১৪০টি)। এখন কর্মরত আছেন ৩৪০ জন। পুলিশ সুপারের (এসপি) ৭৪৬টি পদের মধ্যে মঞ্জুরীকৃত ৫৯৬টি এবং সুপারনিউমারারি ১৫০টি পদ আছে। এই দুটি পদে একটি করে পদ শূন্য রয়েছে। তবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ১ হাজার ৮টি পদের মধ্যে ১৩৮টি পদ শূন্য আছে। সহকারী পুলিশ সুপার পদের ১ হাজার ২৩১টি পদের মধ্যে ১৮৯টির মতো পদ শূন্য রয়েছে। তবে অতি সম্প্রতি এই হিসাবে সামান্য কিছু পরিবর্তন এসেছে বলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।

ওএসডি ও সংযুক্ত অনেকে

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এবং চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে, এমন অন্তত ৩০ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। ৮২ জনকে ওএসডি ও ১১৯ জনকে সংযুক্ত করা হয়েছে। অবশ্য এঁদের অনেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী বা নানা বিতর্কিত কর্মকা-ে ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচার গুলি, মানুষ হত্যার মামলার আসামি আছেন অনেক কর্মকর্তা। জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ওএসডি হওয়া ৮২ কর্মকর্তার মধ্যে ১৩ জন ডিআইজি, অর্ধশতাধিক অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ১৫ জন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের অন্তত ১১৯ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিআইজি ৩০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি ২৯ জন ও পুলিশ সুপার (এসপি) আছেন ৬০ জন। এই কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছেন। পুলিশের এই ১১৯ জন কর্মকর্তাকে সংযুক্ত করা বাহিনীটির ২১টি ইউনিট ও প্রতিষ্ঠানে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৭ জন করে ৩৪ জন কর্মকর্তা সংযুক্ত আছেন রাজশাহী রেঞ্জ ও রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে। রাজশাহীর সারদায় অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে ১১ জন, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে ১০ জন, বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে ১২ জন, সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে ১১ জনকে সংযুক্ত করা হয়েছে।