অনুমোদিত নকশা অনুয়ায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এলাকায় বর্তমানে নির্মাণাধীন ভবনের সংখ্যা ৪ হাজার ৮৩৫টি। তারমধ্যে নকশা বহির্ভূতই ৩ হাজার ৩৮২টি। এসব ভবন সংস্থাটির নকশা অনুমোদনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। সম্প্রতি এসব ভবন চিহ্নিত করেছে রাজউক। এখন চলছে চিহিৃত ভবনগুলোকে আইনের আওতায় আনতে টানা মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমান আদালত)। এই কোর্টের মাধ্যমে নকশার ব্যত্যয়কৃত অংশ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জরিমানাও আদায় করা হচ্ছে। রাজউক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ঢাকাসহ দেশের সব নগরীকে তিলোত্তমা নয়, বরং একটি বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ রাজউক। ঝুঁকিপূর্ণ ও নকশা বহির্ভূত ভবন চিহ্নিত করে এসবের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, হচ্ছেওনা। প্রতিদিনই দুটি করে মোবাইল কোর্ট নকশা বহির্ভূত ভবনগুলোতে অভিযান চালাচ্ছে। ব্যত্যয়কৃত অংশ ভেঙে ফেলা হচ্ছে। নগদ জরিমানাও করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় নির্মাণাধীন ৩৩৮২টি ভবনের অবৈধ অংশ চিহ্নিত করে তা ভেঙে ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। অবৈধ ভবনগুলোর কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে পর্যায়ক্রমে ভবনগুলোর আংশিক ভেঙে ফেলা হচ্ছে। প্রথম ধাপে সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন, ফৌজদারি মামলা দায়ের এবং নকশা বাতিল করা হবে। প্রয়োজনে পরের ধাপে ভবনগুলো সিলগালা করা হবে।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, সংস্থাটির অধিক্ষেত্রের আটটি জোন/অঞ্চলের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুর অবস্থিত। এই ৮টি জোনের প্রতিটিতে রয়েছে তিনটি করে সাবজোন। সব মিলে ২৪টি সাবজোনেই সরেজমিনে তল্লাশী চালিয়ে রাজউকের অনুমোদনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণের খোঁজ পায় সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মীরা। সূত্রমতে, বিগত সরকারের আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাজউক থেকে অনুমোদিত নকশা অনুয়ায়ী নির্মাণাধীন ভবনের সংখ্যা ৪ হাজার ৮৩৫টি। তারমধ্যে জোন ভিত্তিক নির্মাণাধীন ভবনের সংখ্যা বর্তমানে ১ হাজার ৪৫৩টি। এরমধ্যে নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মাণাধীন ভবনের সংখ্যা ৩ হাজার ৩৮২টি। রাজউকের জোন ভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১ নাম্বার জোনে নকশা অনুযায়ী নির্মাণাধীন ব্যত্যয়কৃত ভবনের সংখ্যা ২২৫টি, ২ নাম্বার জোনে ২৭৪টি, ৩ নাম্বার জোনে ৫০৩টি, ৪ নাম্বার জোনে ৪৮২টি, ৫ নাম্বার জোনে ৩৮৬টি, ৬ নাম্বার জোনে ৫৩৬টি, ৭ নাম্বার জোনে ৭৭০টি ও ৮ নাম্বার জোনে রয়েছে ২০৬টি ব্যত্যয়কৃত ভবন। বর্তমানে নকশা অনুযায়ী জোন ভিত্তিক ভবন নির্মাণের সংখ্যা ১ নাম্বার জোনে ২৮৩টি, ২ নাম্বার জোনে ১৩৮টি, ৩ নাম্বার জোনে ৫০টি, ৪ নাম্বার জোনে ৮০৯টি, ৫ নাম্বার জোনে ১১৪টি, ৬ নাম্বার জোনে ২৫টি, ৭ নাম্বার জোনে ১৬টি ও ৮ নাম্বার জোনে কোন ভবন বর্তমানে নির্মাণাধীন নেই।

এর আগে ২০১৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রোববার জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন সংসদকে জানান, মহানগরীতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদিত নকশা বহির্ভূত ও নকশার ব্যত্যয় করে পাঁচ হাজার ভবন নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে রাজউকের দৃষ্টিতে ৩ শ’ ২১টি ভবন ঝূঁকিপূর্ণ।

নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণের হিড়িক : নকশা বহির্ভূত ইমারত (ভবন) নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। যত্রতত্র গড়ে উঠছে অট্টালিকা। মানা হচ্ছে না উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়ম-নীতিমালা। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচারী ভূমির মালিকরা। আরো বেপরোয়া ডেভেলপার কোম্পানিগুলো। নিয়ম-বহির্ভূত এ কাজে নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তাদের পেছনে কিছু অর্থ খরচ করেই বাড়ির মালিক ও নির্মাতারা শাহেনশাহ বনে যান; কারণ কলকাটি নাড়ান ওই অসাধু কর্মকর্তারা। এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের তদারকি থাকে নামমাত্র। ফলে, ইচ্ছাধীন ভবন নির্মাণ করায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। নির্মাণ অবস্থায় অনেক ভবন হেলে পড়ছে। কিংবা নির্মাণের পর পরই ধসে পড়ছে কিছু ভবন।

নগরবিদরা বলছেন, নির্মাণ ত্রুটি এবং নিয়মবহির্ভূত অবৈধ স্থাপনা তৈরির ফলে এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে থাকে। এমনকি, ভবন নির্মাণে ভবন মালিকদের নকশা থাকে দুই ধরনের, অনুমোদনের এক ধরনের এবং ভবন নির্মাণে ভিন্ন রকমের। তাদের দাবি, এ ধরনের অনিয়ম প্রকাশ্যে আসা উচিত। পাশাপাশি, অপরাধীদের শাস্তি ও জরিমানা আদায়ে কঠোর হতে হবে, তাহলে দুর্নীতি কমবে।

৯ তলার অনুমোদন নিয়ে ২২ তলা : ঢাকার গুলশান-১ নম্বর গোলচত্বরের কাছে ২২ তলা জব্বার টাওয়ারের নয়তলা পর্যন্ত অনুমোদন আছে। বাকি ১৩ তলা অবৈধ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদনহীন ভবনের তালিকায়ও জব্বার টাওয়ারের নাম আছে। ভবনের মালিক জাতীয় পার্টির সাতক্ষীরা-২ আসনের সাংসদ এম এ জব্বার ও তার ভাই এম এ গফ্ফার। গুলশান এভিনিউয়ের ১৩৫ নম্বর সড়কের ৪২ নম্বর প্লটে ১৩ কাঠা জমির ওপর নির্মিত ভবনের উচ্চতা ২২০ ফুট। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের বিধি অনুসারে গুলশান এভিনিউ এলাকায় ১৫০ ফুটের (১৫ তলা) বেশি উঁচু ভবন নির্মাণ করা যায় না। ২০০৭ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। রাজউকের নথিতে দেখা যায়, এম এ জব্বার ও এম এ গফ্ফার ২০০৪ সালের ২১ জানুয়ারি নয় তলা ভবন নির্মাণের আবেদন করেন। ২০০৫ সালের ২৭ অক্টোবর ১৫ তলা বাণিজ্যিক ভবন তৈরির জন্য আবেদন করেন। ২০০৬ সালের ৭ ডিসেম্বর রাজউকের বিসি কমিটিতে (বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন) আবেদন উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণ করায় কমিটি ইমারত নির্মাণ আইন অনুযায়ী আবেদনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগেই নকশা না মেনে ভবন নির্মাণের কারণে ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর, ২০০৬ সালের ২৩ জুলাই এবং একই বছরের ৯ আগস্ট তিন দফায় নোটিস দেয়া হয় ভবন মালিককে। মালিকদের আবেদনের পর ২০০৭ সালের ২৮ জুন আবারও বিসি কমিটিতে তা পর্যালোচনা করা হয়। কমিটি ১৫ তলা ভবনের অনুমোদন হওয়ার আগেই নির্মাণকাজ করা এবং নির্মাণ ত্রুটির কারণে নকশা অনুমোদন না করার সিদ্ধান্ত জানায়। ওই বছরের ১০ জুলাই আবেদনকারী রাজউকের আপিল কর্তৃপক্ষের কাছে ২২ তলা ভবনের নকশা অনুমোদনের জন্য দাখিল করেন। কিন্তু আবেদনের সঙ্গে কোনো নকশা ফি বা জমার রসিদ দেয়া হয়নি। ২ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ তাদের আবেদন নাকচ করে দিলেও মালিকপক্ষ ২২ তলা ভবন নির্মাণ করেন।

পরীবাগে ২০ তলা ভবন : পরীবাগে অভিজাত সব উঁচু ভবনের পাশে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে রং-বর্ণহীন ২০ তলা ভবন গার্ডেন টাওয়ার। প্রবেশপথে কোনো ফটক পর্যন্ত নেই। ভবনের চারদিকে প্রয়োজনীয় জায়গাও রাখা হয়নি। রাজউক দাবি করেছে, ভবনটি পুরোটাই অবৈধ। কারণ, এটি নির্মাণের জন্য রাজউকের কোনো অনুমোদনই নেয়া হয়নি। তবে ভবন নির্মাণকারীদের দাবি, এর অনুমোদন আছে। গার্ডেন টাওয়ার নামের এই ভবনে অনেকটা নিরাপত্তাহীনভাবে বসবাস করছে ৬৮টি পরিবার। পরীবাগ শাহ সাহেব রোডের ১ নম্বর প্লটে এর অবস্থান হলেও শেরাটন হোটেলের সামনের রাস্তা থেকে পশ্চিম দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ভবনটি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১৯৯৯ সালে ১০ কাঠা জায়গার ওপর ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। জমির মালিক রিয়াজ সেলিম বিদেশে থাকেন। মোস্তাক আহমেদ মল্লিক ও শফিউল ইসলাম ওরফে ছানা নামের দুই ব্যক্তি আবাসন নির্মাণকারী (ডেভেলপার) হিসেবে ভবনটি তৈরি করেন। ২০ তলা ভবনের ১৮ তলা পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্ল্যাট সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। ওপরের দুটি তলায় শুধু ছাদ করে রাখা আছে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত শহরের কেন্দ্রস্থলে গড়ে ওঠা এই ভবনটির কোনো রকম খোঁজ রাখেনি রাজউক। এক-এগারোর পর রাজধানীর উঁচু ও অনুমোদনহীন ভবনের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হলে রাজউকের পরিদর্শক ভবনটির সন্ধান পান।

গুলশান এভিনিউতে ২০ তলা ভবন : ৭৮ নম্বর গুলশান এভিনিউতে রাজউকের নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা হয়েছে প্রিমিয়ার স্কোয়ার নামে ২০ তলা ভবন। রাজউক থেকে জানানো হয়েছে, ১৩ তলা ভবনের অনুমোদন নিয়ে অবৈধভাবে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। রাজউকের বাধা উপেক্ষা করেই এই বিশাল ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম বলেন, সারা দেশে নকশা বহির্ভূত যেসব ভবন রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে রাজউকের অভিযান চলমান থাকবে। বসবাসযোগ্য নগরী গড়তে কোনো প্রভাবশালী বা ক্ষমতাধর মহলকেও ছাড় দেওয়া হবে না। বিশেষ করে যেসব নির্মাণাধীন ভবনে অনিয়ম পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পূর্বে ভবন নির্মাণে রাজউকের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিয়মে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। রাজউকের মূল কাজ হলো একটি নিরাপদ ও বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলা এবং জনগণকে সেবা প্রদান। এ কাজে জনগণেরও উচিত রাজউককে সহযোগিতা করা। ভবন নির্মাণে সবার প্রতি নিয়ম-নীতির অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণ কাজ পরিচালনা করলেই একটি সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ নগরী নিশ্চিত করা সম্ভব।