২০২৪’র জুলাই আন্দোলনের সফলতা অর্জনে বড় রকমের ভূমিকা রেখেছে টঙ্গির গাজীপুরায় অবস্থিত তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনের আন্দোলনে তাদের ছিল সরব উপস্থিতি। তাদেরই একজন জুনাইদ চান, তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসা টঙ্গী শাখার শিক্ষার্থী। আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘটনার কথা জানিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামকে। পাঠিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামের গাইবান্ধা প্রতিনিধি জোবায়ের আলী। অনুলিখন ইবরাহীম খলিল।

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই আমাদের মাদরাসায় আলিম প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষা চলছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে ছাত্র ভাই বোনদের আর্তনাদ’ আমাকে ডাকছে। পরীক্ষা বাদ দিয়ে সেদিন সকাল ১১:০০ টায় আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও ছাত্র নেতৃবৃন্দ অবস্থান নেই উত্তরা বিএনএস ৬ নং সেক্টরে। সকাল থেকেই পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী আমাদের আন্দোলনকে দমনের জন্য প্রস্তুত থাকে। আমরা স্লোগানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ রাবার বুলেট, ছররা গুলী, সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে, লাঠিপেটা করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা নিরুপায় হয়েও মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। তৎকালীন তামিরুল মিল্লাতের ভিপি মিনহাজ ভাই হাতে মাইক নিয়ে সবাইকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

বেলা ১২ টার দিকে হঠাৎ খবর আশে মিনহাজ (সাবেক ভিপি মিল্লাত) ভাইয়ের চোখে বুলেট লাগে। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি বললেন না ‘আমি এখানে আন্দোলন করবো, হাসপাতালে যাবো না।’ কিন্তু আমরা তাকে তার শরীরের অবস্থা বুঝিয়ে হাসপাতালে রেখে আসলাম। ফিরে আসার একটু পরে তিনটি ছররা গুলী আমার গায়ে এসে লাগে।

কিছুক্ষণ পর পরই লাশ দেখতে পেতাম। মাঝে মাঝে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তাম। এটা কি কোন দেশের সরকারের কাজ হতে পারে ? চিন্তা করতে পারিনি যে, এই ময়দান থেকে ফিরে যেতে পারব কিনা? অধিকাংশ সময় আমি ফ্রন্টে থেকেছি। অসংখ্যবার এমন হয়েছে যে, টিয়ার শেলের ধোঁয়া চোখেমুখে অনবরত লাগায় চোখ খুলে তাকাতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। দৌড়ানোর মত রাস্তা দেখতে পারছিলাম না। একপর্যায়ে আমার পরিচিতদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। রাস্তার একপাশে দেখতে পেলাম, ঘাড়ে গুলী লাগা একজন শিক্ষার্থীকে কয়েকজন মিলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।

সেখানকার স্কয়ার হাসপাতালের পার্শ্ব রাস্তা দিয়ে আমাদেরকে ভেতরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক পর্যায়ে মিল্লাতের তৎকালীন শিবিরের নেতাগণ সাইদুল ভাই, আফিফ ভাই, মাহাদী ভাই, রায়হানুল কবীর ভাইদের দেখতে পাই। আফিফ ভাইয়ের স্লোগানে যেন রাজপথ কেঁপে উঠছিল। অনেকক্ষণ যাবৎ আমি তাদের সাথেই ছিলাম। সকাল থেকেই কেউ না কেউ বিস্কুট, পানি, খাবার স্যালাইন ইত্যাদি খাবার বাসা বাড়ি থেকে দিয়ে যাচ্ছিল। মহৎ ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, বি¯ু‹ট, পানি খাও, আঁখের রস খেয়ে যাও, শক্তি পাবা। মনে হচ্ছিল তারা যেন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক। তারা ভাবেনি এতে তার লস হবে কি-না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল। পুলিশের অস্ত্রে বুলেটের সংখ্যা কমে আসে। এক পর্যায়ে তারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং আমাদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দিবে না বলে আশ্বস্ত করে। আমরা তাদের কথায় সম্মত হয়ে তাদের নিরাপদ স্থানে যেতে দেই। তারা যাওয়ার ২০ মিনিট পর যৌথ বাহিনীর একটি টিম এসে আমাদের এলোপাতাড়ি গুলী করা শুরু করে। চোখের সামনে ১৫ থেকে ২০ জন গুলীবিদ্ধ হয়ে পড়ে যায়। তখন সামনেই ছিলাম। ভিড়ের কারণে আমাকে গুলী লাগেনি। বিকাল তিনটার দিক থেকে পুলিশের গুলী চালানোর মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তারা তখন রাবার বুলেট, ছররা গুলী এগুলো চালিয়েও থেমে থাকেনি, তারা সীমান্তে ব্যবহৃত স্নাইপার গুলীর বুলেটও অতিমাত্রায় প্রয়োগ করে। মিনহাজ ভাই চোখের ক্ষত নিয়ে আবারও মাঠে নেমেছিল। পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়ে আসছিল। সেখানকার একটি বিল্ডিংয়ের ছাদও বাদ যায়নি; সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছিল না! এমনকি উত্তরা পূর্ব থানার ছাঁদে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতারা সেখানে অবস্থান করতেছিল। তারপরও আমরা আন্দোলন হতে এক চুল পরিমান পিছপা হইনি।

এসময় মিল্লাতের সাবেক ভি পি মিনহাজ ভাই সবাইকে একত্র হওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমি এবং ছাত্র শিবিরের সাথী সিফাতুল্লাহ ভাই শেষবারের মতো পরিস্থিতি দেখার জন্য আজমপুর ওভার পাস এর নিচে অবস্থান করি। সারাদিন আন্দোলন করে অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। গায়ে জোর নিয়ে বসা থেকে উঠলাম। এরই মাঝে স্নাইপার গুলীর একটি বুলেট আমার ডান হাত ভেদ করে চলে যায় । কিন্তু তখনও বুঝতে পারি নি। গুলীর আওয়াজ মাত্রই যখন ঘুরে দৌড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। ঠিক ওই মুহূর্তেই উত্তরা পূর্ব থানার ছাঁদ-এর ওপর থেকে দ্বিতীয়বারের মতো করা স্নাইপার গুলীর বুলেট হঠাৎ বুকের নিচে এসে লাগে। যেন মনে হলো শরীরের ভেতরে বাতাস প্রবেশ করছে। সিফাত ভাই আমাকে বলল, “ভাই গুলী লেগেছে!" তখন কথা বলতে পারছিলাম না। আমি মাথা নাড়ালাম। বুঝতে পেরে সে বলল, এখানে থাকা যাবে না, চলো। কারণ তখন তারা লাগাতার ১০ রাউন্ড গুলী চালিয়েছে। আমার পাশে এক বৃদ্ধ লোক ছিল, তার মাথায় গুলী লেগে তিনি ওখানে সঙ্গে সঙ্গেই শহীদ হন। সিফাত ভাইয়ের সাথে দৌড়ানোর সময় হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে, হাত থেকে ঝরঝরে রক্ত পরছে। তখনো ঠিক বুঝতে পারিনি যে আমার হাতে কি হয়েছে। প্রায় ৫০ মিটার দৌড়ানোর পর আর দৌড়াতে পারছিলাম না। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছিল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার সময় সেখানকার কয়েকজন মিলে আমার হাত পা ধরে নিয়ে যায় অনেকটা জায়গা। কাতরাচ্ছিলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন মনে হলো এই চাহনি বোধহয় শেষ চাহনি। মা-বাবার কথা প্রচন্ড মনে হচ্ছিল। কারণ তাদের না জানিয়ে এই আন্দোলনে চলে এসেছিলাম। আল্লাহকে ডাকতে ছিলাম। মনে হচ্ছিল, কখন যে রুহুটা বের হয়ে যায়।

মোড়ের কাছে গেলে সেখানে মেডিকেল টিমের লোকেরা আমার হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয় এবং একটি শার্ট দিয়ে আমার পেট বেঁধে দেয়। মিল্লাতের থানা সভাপতি নিজাম ভাই আমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রক্তাক্ত শরীর দেখে তিনি আমায় চিনতে পারেন নি। আমাকে কুয়েত মৈত্রী-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমার তৎকালীন থানা সভাপতি মাসুম বিল্লাহ ভাই গুলী লাগার খবর পেয়ে ভিপিসহ অন্যান্য দায়িত্বশীল ভাইদেরকে অবগত করেন। হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছিলাম। গুলীবিদ্ধ রোগীর সংখ্যা এতটাই ছিল যে ডাক্তার তাদের চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছিলেন । অন্যদিকে, ছাত্রলীগের গুন্ডারা হাসপাতালে কাউকে চিকিৎসা নিতে দিচ্ছিল না। ডাক্তার বলেছিলেন আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিতে হবে। নয়তোবা বাঁচানো সম্ভব হবে না। দেরি না করে তৎক্ষণাৎ আমার দায়িত্বশীল ভাইয়েরা এম্বুলেন্স-এর খোঁজ করছিলেন। একজন আনসার আমার পরিবারের নাম্বার নিলেন। আমার বাবাকে অবগত করা হলো। মা গুলী লাগার খবর শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বাবা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন।

হাতের চেয়ে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। আমাকে সেখানেই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। অজ্ঞান না করে শুধুমাত্র অবশ করেই ক্ষতস্থানে কেটে অপারেশন শুরু করে। বুলেট খুঁজে না পেয়ে পেটে সেলাই করে দেওয়া হলো। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অ্যাম্বুলেন্সে উঠে তিনবার রক্ত বমি করেছিলাম। ভাইদেরকে বলছিলাম, “ আমার জন্য দোয়া করেন , আল্লাহ যেন আমায় শহীদ হিসেবে কবুল করেন।” রাস্তা অনিরাপদ হওয়ায় অনেক ঘুরে ঘুরে কর্মীটোলা জেনারেল হাসপাতালে যেতে হয়। কুর্মিটোলা হাসপাতালে যাওয়ার সাথে সাথেই আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আমার চাচা আমজাদ হোসেন হাসপাতালে আসেন। ডাক্তার সর্বপ্রথম হাতের অপারেশন করতে ছিলেন। সম্পূর্ণ হাত যখন পরিষ্কার করছিলেন মেডিসিন দিয়ে। তখন দেখতে পেলাম হাতের এক পাশ থেকে অন্য পাস দেখা যায়। মাঝখানে যেন এক বিশাল গর্ত। হাতের অসংখ্য রগ ছিঁড়ে যায়। পেটের অপারেশনের জন্য আরেকটি অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। লিখিত নিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে অপারেশন করা হয়। গুলী লাগার পর থেকে অজ্ঞান করা পর্যন্ত আমি সবসময় সজ্ঞানে ছিলাম। ডাক্তাররা আমার পেট থেকে নাড়ি ভুঁড়ি বের করে প্রায় দুই ঘন্টা খোঁজাখুঁজি করে বুলেট টি পেতে সক্ষম হয়। আমার পেটের নাড় দশ জায়গায় ফুটো হয়। এরপর আমাকে আই সি ইউ তে রাখা হল। দুইদিন পর ওয়ার্ডে গেলাম। আমার বাড়ি গাইবান্ধায় হওয়া সত্ত্বেও আমার বাবা কারফিউ ভঙ্গ করে তিন দিন পর আমার কাছে আসেন। শিবিরের ভাইয়েরা আমার কাছে থাকায় তিনি অনেকটা স্বস্তি পেয়েছেন। ডান হাতে প্লাস্টার, বাম হাতে স্যালাইন, পেটে ওপেন হার্ট সার্জারির মতো অপারেশন। বেডে শুয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। বাবাকে দেখে যেন আত্মাটা ভরে গেল। বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাবাকে ইশারায় ডাকলাম। বাবা আমাকে দেখে নিজের চোখের অশ্রু টেনে নিলেন। যাবতীয় খরচ শিবির থেকে বহন করা হচ্ছিল। প্রতিনিয়তই তিন থেকে চারজন শিবিরের ভাই আমার সেবা করার জন্য থাকতেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাদের এ ঋণ পরিশোধযোগ্য নয়। ক্লান্তিময় দিন পাড়ি দিচ্ছিলাম। ৩ আগস্ট খুনি হাসিনা, সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান, তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ হাসিনার দলবল নিয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে অসুস্থ রোগীদের দেখতে আসে। মিডিয়ার সামনে অভিনয়ের কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে । ৫ আগস্ট সকালে আমার বাবা আমাকে হাসপাতালে রেখে সবার সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। ফোনটাও রেখে গিয়েছিলেন। অনেক চিন্তা হচ্ছিল তার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, একপর্যায়ে তিনি চলে আসেন। হাসিনা পালানোর খুশিতে যখন সবাই আনন্দ করছিল তখনও আমি আনন্দে হাসতেও পারছিলাম না পেটের ব্যথার জন্য।

হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে হাতের চিকিৎসার জন্য বেরিয়ে পড়ি। অপারেশনের সময় ঠিক করে বাড়িতে গেলাম। ততদিনে একটু বাঁকা হয়ে হলেও হাঁটতে পারি। শুকরিয়া আল্লাহর যিনি মায়ের কোলে আবারও ফিরিয়ে দিয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের হাজার হাজার শহীদ এবং আহতদের রক্তস্রোতের ওপর দিয়ে আজ আমরা এইখানে এসে পৌঁছেছি। স্মরণ করছি সেই মহান শহীদদের, যাদের এই মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়ে দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু এই স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।