দীর্ঘ দেড় মাসের টানাপোড়েন শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে সব কার্যক্রম। আন্দোলন প্রত্যাহারের পর রোববার রাত থেকেই কর্মকর্তারা কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেন। গতকাল সোমবার সকাল থেকে পুরোদমে কাজ শুরু হয়।

গত রোববার রাতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাকক্ষে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এরপর থেকেই আগারগাঁওয়ের প্রধান কার্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন কাস্টমস, ভ্যাট ও কর অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগ দিতে শুরু করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, চলমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। সকাল থেকেই প্রধান কার্যালয়ে ফাইল চলাচল ও নথিপত্র যাচাই-বাছাই পুরোদমে শুরু হয়েছে। এর আগে এনবিআর চেয়ারম্যানের অপসারণ ও কাঙ্ক্ষিত প্রশাসনিক সংস্কারের দাবিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ দীর্ঘ দেড় মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। শাটডাউন, কর্মবিরতি, অবস্থান কর্মসূচিসহ ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আহরণ ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে আসে।

ব্যবসায়ীরা জানান, এই অচলাবস্থার কারণে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স বিলম্বিত হওয়ায় আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ, এফবিসিসিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠন বারবার দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানিয়ে আসছিল। শেষ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে সংকটের অবসান ঘটায় সংশ্লিষ্ট মহলে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার সকাল থেকে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও অন্যান্য কাস্টমস হাউজ এবং কর অফিসগুলোতেও কর্মকা- স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কর্মকর্তারা এখন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আটকে থাকা ফাইল ও জরুরি রাজস্ব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এনবিআরের কার্যক্রম স্বাভাবিক হওয়ায় আমদানি-রফতানি, ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক গতি ফিরে আসবে। তবে তারা এটিও বলছেন, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে প্রশাসনিক ও কাঠামোগত সংস্কার জরুরি।

দুদকের তদন্তে সরকারের হস্তক্ষেপ নেই: এনবিআরের আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত সম্পর্কে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, দুদকের কার্যক্রমে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো হস্তক্ষেপ নেই। গতকাল সচিবালয়ে ৭২টি রাষ্ট্রায়ত্ত ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নতুন বাজেট ব্যবস্থা ঘোষণা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। অর্থসচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন, অতীতেও দেখা গেছে, সরকার দুদককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এনবিআরের আন্দোলনের মধ্যে ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত কি আগের সরকারের ধারাবাহিকতায় করা হয়েছে? এই প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা এ কথা বলেন। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয় না; বরং আগে যারা গবর্নর ছিলেন, তারা অনেক সময় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এখন সেই ধারা বদলেছে। অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, কেউ চাইলে ভাবতে পারেন, এই সময়ে অনুসন্ধান শুরু হলো কেন। তবে এনবিআর ও বন্দর বন্ধ-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে প্রতিদিন আমার কাছে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ নিয়ে এসেছেন হিসাব বন্ধ, বড় ক্ষতি হয়েছে ইত্যাদি। এটা কিন্তু একদম গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় স্বার্থ-সংক্রান্ত সেবা বন্ধ করা চলে না উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এনবিআর হোক বা বন্দর, এসব তো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটা সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে রাজস্ব আসে। আপনি যদি একতরফাভাবে একটি সেবা বন্ধ করে দেন, সেটা জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। তবে এনবিআরের সমস্যার সমাধান হওয়ায় সরকার খুশি। এখন যৌক্তিকভাবে সমাধানের পথ বেরোচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

আন্দোলনে যুক্ত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে উপদেষ্টা বলেন, ভালো করে কাজ করুন। পক্ষপাত বা ভয় ছাড়া কাজ করতে হবে। জনসেবা যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে হয়, সেটা হলে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কেউ বিচ্যুতি ঘটালে জবাবদিহি করতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। ঘুষের বিনিময়ে করদাতাদের কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ছয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তারা হলেন-আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম, নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা, অতিরিক্ত কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার সাধন কুমার কু-ু ও যুগ্ম কর কমিশনার মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান। এনবিআর সূত্র বলছে, অনুসন্ধানের মুখে পড়া অন্তত পাঁচ কর্মকর্তা এনবিআরের আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি। এই ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এত দিন এনবিআরে আন্দোলন হয়েছে।

রাজস্ব আদায় গতবারের চেয়ে বেশি হবে: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেছেন, গতবারের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেশি হবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু যেরকম আশা করছিলাম, একটু তো হোঁচট খেয়েছি এই কয়দিনের কাজকর্মে। গতকাল সোমবার এনবিআর ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। বিগত এক সপ্তাহ ধরে চেয়ারম্যান অপসারণের জন্য আন্দোলন করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। সরকারের কঠোর পদক্ষেপে আন্দোলন প্রত্যাহার করে সংগঠনটি। এরপর প্রথম গতকাল সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এনবিআর চেয়ারম্যান।

তিনি বলেন, আজ (সোমবার) সকাল ১০টা পর্যন্ত আমাদের রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। আজ যেটা ট্রেজারিতে জমা হবে সেটার রিপোর্ট কাল পাব। এর বাইরে সরকারি প্রকল্পের কর বা মূসকের বিল থাকে; যেটা আদায় হয়, সেটা সমন্বয় করতে কিছুটা সময় লাগবে। নরমালি জুন ক্লোজিং-এ একটু সময় লাগে। ২-৩ সপ্তাহ লেগে যাবে ফাইনাল ফিগার আসতে। এনবিআর চেয়ারম্যান আরও বলেন, এখন আমাদের রেভিনিউ রিপোর্টিংটা সিস্টেমেটিক। আমরা ম্যানুয়াল রিপোর্ট করি না। আইবাসে আমরা আদায়ের রিপোর্ট করি।

গত কয়েকদিনের আন্দোলনে ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘিœত হয়েছে উল্লেখ করে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব আদায় হোঁচট খেয়েছে। আজকেও সময় আছে, আজকে তারা (কর্মকর্তারা) চেষ্টা করছেন। ট্যাক্স অফিসারদের প্ল্যানের মধ্যে আছে কারা ট্যাক্স পেয়ার, কারা বছরের শেষে কর দিবে। এটা তারা জানেন। আজ সব দপ্তর খোলা, ব্যাংক খোলা। তিনি বলেন, আমার ধারণা আজকে (সোমবার) ভালো পরিমাণ অর্থ জমা হবে। সরকারি বিলগুলো অ্যাডজাস্ট করলে গতবারের চেয়ে বেশি হবে এটা নিশ্চিত। একটা নির্দিষ্ট অংশের গ্রোথ হবে। আমরা যেরকম আশা করেছিলাম হয়তো সেটার কাছাকাছি থাকবে। তারপরেও জুলাই মাসে আবার ড্রাইভ দিয়ে আমরা এটা ট্রেজারিতে নিয়ে আসব। জুলাই মাসে আমাদের টাকা লাগবে। সরকারকে জুলাই মাসে খরচ করতে হবে। আমাদের কর্মতৎপরতা আগের মতো চলবে। কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যা কিছু হয়েছে সব ভুলে গিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, দেশের স্বার্থে আমরা সবাই কাজ করব। যে কাজগুলো আছে সেগুলো এগিয়ে নিয়ে যাব। আশা করি আমাদের আর এ ধরনের সমস্যার মধ্যে যেতে হবে না। অতীতে রেভিনিউ অফিসাররা যেভাবে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেছেন, একইভাবে তারা কাজ করবেন।

এনবিআরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কাস্টমস হাউজগুলো রোববার বিকেল থেকেই কাজ শুরু করে। তারা কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছেন। এর ফলে সবার মাঝে স্বস্তি বিরাজ করছে। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে ও নীতি নির্ধারকদের মধ্যে। সকাল থেকেই আমাদের সব দপ্তরে কাজ শুরু হয়েছে। সম্পূর্ণ উপস্থিতি আছে। সব কাস্টমস হাউজ, আইসিডি, ভ্যাট ও কর অফিস সবাই কাজ করছে। যেহেতু আজ ৩০ জুন (অর্থবছরের শেষ দিন), আজকে আমাদের একটা বড় ড্রাইভ থাকে। রেভিনিউগুলো যেগুলো পাইপলাইনে আছে সেগুলো ট্রেজারিতে নিয়ে আসার একটা ক্রমাগত চেষ্টা থাকে। সেই চেষ্টাটা চলছে।