অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, উৎসবমুখর পরিবেশে জুলাই সনদ সই হবে ১৭ অক্টোবর। জাতি অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ^স্ত করে বলেছেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন অবশ্যই উৎসবমূখর হবে। উৎসবমূখর নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার সব করবো। শুক্রবার সবাই জুলাই সনদে সাক্ষর করে অনুষ্ঠানকে সফল করবেন বলেও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা।

গতকাল বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিকদলগুলো একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হবেই। উৎসবমুখর পরিবেশে হবে। তার জন্য যা যা করতে হয়, সাধ্য অনুযায়ী আমরা সবকিছু করব। এর সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করা হবে না। প্রফেসর ইউনূস বলেন, কথার কথা নয়, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে সকল পদক্ষেপ নেবে সরকার। ঐকমত্য সনদেরই অংশ এটি। আমরা এ বিষয়ে কোনো কম্প্রোমাইজ করবো না। নির্বাচন যেন যুৎসই হয় সেই বিষয়ে সবাইকে এক থাকার আহ্বান জানান তিনি।

রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের দীর্ঘদিনের আলোচনার ফসল জুলাই সনদ। আপনারা অনেক ভেবে-চিন্তে মতামত দিয়ে জুলাই সনদকে একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে এনেছেন। এতে আপনারা ইতিহাসের অংশ হয়ে গিয়েছেন। হয়তো প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকায় আপনারা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছেন না। জুলাই সনদের কপি সবার কাছে পৌঁছে দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমি যতদিন থাকবো আপনাদের তৈরি দলিলগুলো সংরক্ষণ এবং প্রচার করবো। সবার কাছে আমি কপি পৌঁছে দেবো, যাতে আপনারা সবাই দলিলগুলো দেখে অনুধাবন করতে পারেন কী সব বিষয়ে আপনারা একমত হতে পেরেছেন। এটা সঞ্চারণ করতে হবে। যাতে সবার কাছে পরিষ্কার ধারণা থাকে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যে দলিলগুলো আপনারা তৈরি করেছেন সেগুলো হারিয়ে যাবে না। আমি যতদিন পারি চেষ্টা করবো এগুলো যেন প্রত্যেকের কাছে যায়। যেন সবার মনের মধ্যে থাকতে পারে কেন আমরা একমত হতে পেরেছি। একমত হওয়া এক জিনিস, এটাকে সঞ্চারিত করা এক জিনিস। এই সঞ্চারণের দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে সরকার হিসেবে, আমরা প্রক্রিয়া শুরু করবো। বিষয়গুলো জনগণের কাছে প্রচার করার মতো ভাষায় প্রচার করতে হবে। আমি বলে রেখেছি, আপনারা যে বিতর্কগুলো করেছেন এগুলো অমূল্য সম্পদ। এগুলোকে বিষয়ভিত্তিকভাবে ভিডিও করে, বই করে আমাদের কাছে থাকবে, যাতে হারিয়ে না যায়। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রচার করলে সবার কাছে পরিষ্কার হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে অসম্ভবকে আপনারা সম্ভব করেছেন সেটা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে না, পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে। আপনারা কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সমাধানে এসেছেন। নিজেরা সবাই আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছেন, একটা ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছেন। এ জন্য আজকে জুলাই সনদ রচনা হয়েছে। সেজন্য আমি একা নই, জাতির সবাই অভিভূত হয়েছে। তিনি বলেন, আজকে যেই পয়েন্টে এসেছি, সেটা একটা অবিশ্বাস্য কা-। মানুষ চিরদিন স্মরণ করবে, বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে সবাই গর্বিত। আমি একজন ব্যক্তি হিসেবে গর্ববোধ করছি যে এই কাজের সঙ্গে আমি শরিক ছিলাম, অংশীদার ছিলাম। যে অসম্ভব কাজ আপনারা করলেন এটা যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো একটা দিন।

প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান তারপরে এটাই মনে হয় সঠিকভাবে রচিত হলো। কাজেই জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানে সারা জাতি শরিক হবে। যেই কলমে সই করা হবে সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। যে যে কলম দিয়ে সই করবেন তার মুহূর্ত জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হবে। কারণ কেউ ভুলতে পারবে না আপনাদের। এটা এমন একটা ঘটনা, আমরা যেহেতু ঘটনার ভেতরে আছি বলে অনুভব করতে পারছি না। বাইরে গিয়ে যদি দাঁড়াতে পারতাম তাহলে মনে হতো বিশাল একটা কাজ। মাসের পর মাস বৈঠক করে হয়তো মনে করেছেন এটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। এটা অসমাপ্ত থেকে যায় নাই। সন্তোষজনকভাবে আপনারা সমাপ্তিতে এনেছেন। আপনারা ভেবেচিন্তে নিয়ম-কানুন বের করেছেন, যাতে সবাই সনদে সই করতে পারেন। এটা জাতির জন্য একটা মস্ত বড় সম্পদ রয়ে গেলো। এ জন্য আপনাদের সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনারা সবাই যে পরিশ্রম করেছেন তা জাতি হিসেবে সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি (রব), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এবি পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট দেওয়া হলে এর কোন গুরুত্ব থাকবে না। তিনি বলেন, আমরা নবেম্বরে গণভোটের পরামর্শ দিয়েছি। সেইসাথে হ্যাঁ এবং না পদ্ধতিতে আগেও ভোটের নজির রয়েছে বলে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি। এর আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, জুলাই সনদের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহ এবং ঐকমত্য কমিশন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন এবং মাসের পর মাস আলোচনা করেছে। এতে অনেকগুলো বিষয়ে একমত হয়েছে। অনেকগুলো বিষয়ে মতবিরোধ হয়েছে। আমি মনে করি মতের পার্থক্য ঐক্যকে শক্তিশালী করে। তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের কারণে ৫৪ বছরের সংস্কৃতি বদল হয়েছে। এগুলো জাতির কাছে উপস্থাপিত হয়েছে। এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই জাতি তাদের রায় প্রদান করবে। তিনি বলেন, জুলাই সনদের বিষয়ে যেসব বিষয়ে এক মত হয়েছি, সেবিষয়ে আমরা সনদে সাক্ষর করতে যাচ্ছি। তিনি উল্লেখ করেন আমাদের এসব ম্যান্ডেট নিতে জাতির কাছে যাওয়া দরকার। তা গণভোটের মাধ্যমে। এসময় তিনি নবেম্বরে গণভোট দেওয়ার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তিন জন আলোচনায় অংশ নেন। তারা হলেন জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ ও নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হলে আমরা এফোর্ট করতে পারবো না। আমরা চাই আপনার (ড. ইউনূস) সঙ্গে প্রতিরক্ষাবাহিনীর সুসম্পর্ক থাকুন। রাষ্ট্রের একটা ব্যালেন্স থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে আমরা কোনো ধরনের ঝামেলার মধ্যে যেতে চাই না। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের দোসর একটি দেশ যে কোনো সুযোগ নেওয়ার জন্য বসে থাকবে। সুতরাং আমাদের অতিবিপ্লবী হলে চলবে না। বাস্তবতার নিরিখে থাকতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষরের সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। যেকোনো উপায়েই হোক ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর হলেও পরবর্তীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদেরকেই এর আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি জাতীয় সংসদের ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, আমরা জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করব, তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ যেগুলো রয়েছে, সেগুলো অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, শেষ মুহূর্তে কিছু বিষয় আমাদের মধ্যে সংশয়ের জায়গা তৈরি করেছে। আসলে জাতিকে অস্পষ্ট রেখে কোনো উদ্যোগ সফল করা সম্ভব নয়। আখতার হোসেন বলেন, আজকের এই দিনে আমরা হতে পেরেছি এমন একটি অবস্থানে, যাতে বাংলাদেশে আর কখনো ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে। বাংলাদেশ যেন জবাবদিহিতা-পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হতে পারেÑ সেই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে ঐক্যবদ্ধ কমিশনের রাজনৈতিক দলগুলো এক অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে, সুন্দর সহনশীল পরিবেশের মধ্য দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে প্রণয়নের দিকে এগিয়েছি। জুলাই সনদের খসড়া পাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে ‘নোট অফ ডিসেন্ট’-এর বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হয়নি। ‘নোট অফ ডিসেন্ট’-এর একটি সংজ্ঞা প্রয়োজন, এবং যেভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে, সে পথনকশা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

এর আগে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হয়। বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এদিন সন্ধ্যা ৬টার কিছু সময় পর এ বৈঠক শুরু হয়।

এর আগে বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিকেলের বৈঠকে কমিশনের পক্ষ থেকে বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন।

জুলাই সনদে যা থাকছে :

সনদে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কিছুটা কমানো, কিছু প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি ও বিরোধী দলের সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগের বিধান করা, কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে দেওয়া, আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা, এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন এবং একই ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন নাÑএমন বিধান করা, আস্থা ভোট ও অর্থবিল ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে আইনসভায় সংসদ সদস্যদের ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণসহ বেশ কিছু মৌলিক সংস্কারের প্রস্তাব আছে। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তাবে বিএনপিসহ কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। কোন প্রস্তাবে কার ভিন্নমত আছে, তা সনদে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম পর্বে ঐকমত্য হওয়া বিষয়ের মধ্যে আছে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলকে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় আনা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা, আইনজীবীদের আচরণবিধি, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন, তথ্য অধিকার আইনের সংশোধন, দুর্নীতিবিরোধী কৌশলপত্র প্রণয়ন, নির্বাচনী অর্থায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে সংশোধন, দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি, আয়কর আইনের সংশোধন ইত্যাদি।

দ্বিতীয় পর্বে ১১টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য হয়। সেগুলো হলো: ১. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, ২. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা-সম্পর্কিত বিধান, ৪. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণÑ (ক) সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ, (খ) উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, ৫. জরুরি অবস্থা ঘোষণা, ৬. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, ৭. সংবিধান সংশোধন, ৮. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল (এক ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন), ৯. নির্বাচন কমিশন গঠন, ১০. পুলিশ কমিশন গঠন, ১১. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব।

সনদে যেসব বিষয়ে কোনো কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমত আছে সেগুলোর মধ্যে আছে: ১. রাষ্ট্রের মূলনীতি: এই প্রস্তাবে ভিন্নমত আছে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণফোরামের। ২. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব: কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, এলডিপির।৩. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান: ভিন্নমত আছে বিএনপি, এনডিএম, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের।৪. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা: গঠনপ্রক্রিয়ার একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত একমত হলেও পরের ধাপ নিয়ে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের ভিন্নমত আছে। অন্যদিকে একটি অংশে ভিন্নমত আছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। কোন ধরনের দল (নিবন্ধিত/অনিবন্ধিত) উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করবে, তা নিয়ে ভিন্নমত।৫. উচ্চকক্ষ: পিআর ও প্রার্থী তালিকা প্রকাশ নিয়ে ভিন্নতম বিএনপি ও এনডিএমের।৬. উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা নিয়ে ভিন্নমত সিপিবি, এনডিএম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, আমজনতার দলের।৭. নারী আসনের বিধান: সিপিবি, বাসদ, আমজনতার দলের ভিন্নমত।৮. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ (ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক): বিএনপিসহ ৭টি দল ও জোটের ভিন্নমত।৯. দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করা: বিএনপিসহ সাতটি দল ও জোটের ভিন্নমত।১০. দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের একটি ধারা (নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সম্পর্কিত) সংশোধন: জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভিন্নমত।

সাত বিষয়ে অঙ্গীকার

জুলাই সনদের শেষ অংশে আছে সনদ বাস্তবায়নে সাত দফা অঙ্গীকারনামা। এই সাত বিষয়ে অঙ্গীকার করে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে সই করবে। ১. ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা হবে।২. জনগণের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় সাধারণত প্রতিফলিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ গ্রহণ করছে। তাই এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করা হবে।৩. দলগুলো সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তুলবে না। উপরন্তু সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে দলগুলো আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।৪. দীর্ঘ ১৬ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।৫. গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকা-ের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।৬. সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করা হবে।৭. যেসব সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো কোনো কালক্ষেপণ না করে দ্রুততম সময়ে অন্তর্র্বর্তী সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।

কিছু সংশোধন

এর আগে সনদের খসড়ায় বলা হয়েছিল, শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু, নারীসহ প্রায় ১ হাজার নাগরিক নিহত হন এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হন। তাঁদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু-নারীসহ সহস্রাধিক নিরস্ত্র নাগরিক নিহত হন এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ গুরুতর আহত হন। তাঁদের আত্মাহুতি, ত্যাগ এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের মুখে ‘ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা’ ও তাঁর দোসররা পরাজিত হয়ে অনেকেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। খসড়ায় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্র্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। চূড়ান্ত সনদে সেটা সংশোধন করে বলা হয়েছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।