বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেড়েই চলছে বায়ুদূষণের মাত্রা। দিন দিন ঢাকার বাতাস দূষিত হয়ে উঠছে। টানা কয়েক মাস ধরে বাতাসের মান খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল। গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকালেও ঢাকার বাতাস ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার থেকে এ তথ্য জানা যায়। বায়ুদূষণ এক ধরনের নীরব ঘাতক। বাইরের দূষণ ছাড়াও ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ রোধে যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন। ঘরের ভেতরে দূষণে জন্মের প্রথম মাসে বিশ্বে প্রায় পাঁচ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। বায়ুদূষণ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে থাকে। এটা সব বয়সী মানুষের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি, প্রবীণ ও অন্তঃসত্ত্বাদের জন্য বায়ুদূষণ খুবই ক্ষতিকর। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশনের (ডব্লিউএইচও) মতে, বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে বায়ুদূষণের কারণে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার, শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৮৮ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআর, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র এবং আইসিডিডিআর,বি এক গবেষণার ফলাফলে জানায়, বাংলাদেশে সাড়ে তিন কোটির অধিক শিশু শরীরে ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। সেজন্য শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে বছরে ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে তার অধিকাংশই বায়ু দূষণজনিত। সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বায়ুদূষণে বাংলাদেশীদের গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর রাজধানীবাসীর গড় আয়ু কমছে ৮ বছর করে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।

গত ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে। বায়ুদূষণ থেকে রক্ষা পেতে পরিবেশ অধিদপ্তর বিশেষ সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে। রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকার জনসাধারণকে দূষণ থেকে রক্ষা পেতে বাইরে যাওয়ার সময় অবশ্যই মাস্ক পরিধান করা এবং অতি প্রয়োজন ছাড়া সংবেদনশীল ব্যক্তিদের (অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু) বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো মতে জানা যায়, ২০২২ সালে বিশ্বে সবচেয়ে বায়ুদূষণকারী বাংলাদেশে বায়ুদূষণের ফলে গড়ে সাত বছর করে মানুষ আয়ু হারায়। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার গৃহীত পদক্ষেপ গ্রহণে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ। ঢাকার বাতাস দূষণমুক্ত রাখতে বেশ কিছু আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ কম। বায়ুদূষণ রোধে নানা ধরনের প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ রয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ৬ নম্বর ধারার উপধারা (১) মোতাবেক, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ধোঁয়া নিঃসরণকারী যানবাহন পরীক্ষা ছাড়া চালানো যাবে না। বিধি লঙ্ঘনকারীকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা এক বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। ইটভাটা দূষণরোধ আইন বলছে, জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স না নিয়ে ইট প্রস্তুত করলে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। বায়ুদূষণ কমাতে দেশে ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট’ থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন প্রয়োগে বায়ুদূষণ রোধে কম প্রভাব পড়ে। বৃক্ষনিধনের জন্যও রয়েছে আইনগত শাস্তির ব্যবস্থা, যার প্রয়োগ নেই বললেই চলে।

বায়ুদূষণ নিয়ে কমিউনিটি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের এখানে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যারা মারা যায় তাদের চার ভাগের এক ভাগ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্ট এবং ফুসফুসের নানা রোগে ভোগেন এখানকার মানুষ। এছাড়া হাইপারটেনশনে আক্রান্ত হন, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন গর্ভবতী মা ও শিশুরা। বন্ধ্যাত্ব এবং পুরুষত্ব হারানোর পিছনেও আছে বায়ুদূষণ।

সিআরইএর বায়ুমান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি বলেন, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। তিনি আরো বলেন, ‘বায়ুদূষণ অর্থনীতিকেও দুর্বল করে, প্রতি বছর প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি হয়।

এদিকে ২৪১ স্কোর নিয়ে গতকাল শুক্রবার বায়ুদূষণে শীর্ষে নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু যা এখানকার বাতাসের মান নাগরিকদের জন্য ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’। একই সময়ে ২০৭ স্কোর নিয়ে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের শহর ‘দিল্লি’। এছাড়াও ১৬১ স্কোর নিয়ে অস্বাস্থ্যকর শহরের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে চীনের শহর ‘বেইজিং’। আর ১৫২ স্কোর নিয়ে এ তালিকার ৭তম অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ‘ঢাকা’। আইকিউএয়ার স্কোর শূন্য থেকে ৫০ ভালো হিসেবে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ মাঝারি হিসেবে গণ্য করা হয়, আর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয় ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু বলে মনে করা হয়। ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। এ অবস্থায় শিশু, প্রবীণ ও অসুস্থ রোগীদের বাড়ির ভেতরে এবং অন্যদের বাড়ির বাইরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া ৩০১ থেকে ৪০০-এর মধ্যে থাকা আইকিউএয়ার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচিত হয়, যা নগরের বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। সাধারণত একিউআই নির্ধারণ করা হয় দূষণের পাঁচটি ধরনকে ভিত্তি করে। যেমন- বস্তুকণা (পিএম১০ ও পিএম২.৫), এনও২, সিও, এসও২ ও ওজোন (ও৩)।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর মতে, ঢাকার বায়ুদূষণে সর্বোচ্চ দায়ী নির্মাণকাজ (৩০ শতাংশ)। মানুষের প্রয়োজনে রাজধানীতে গড়ে উঠছে নানা অবকাঠামো। আর এসব নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইট, বালি, সিমেন্ট খোলা ট্রাকে করে এক জায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর এবং নির্মাণকাজ চলাকালে অসতর্কতার কারণে বাতাসে ছড়াচ্ছে সূক্ষ্ম বিষাক্ত কণাবস্তু। এরপর বায়ুদূষণের শতকরা হারে রয়েছে ইটভাটা, যা মোট দূষিত পদার্থের ২৯ শতাংশ। রাজধানীর অনতিদূরে আইনের পরিপন্থি ইটভাটা নির্মাণের কারণে ভাটা থেকে লোকালয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসে প্রতিনিয়ত বিষ ছড়াচ্ছে। নিয়ন্ত্রণহীন মোটরগাড়ির কালো ধোঁয়া ১৫ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে চিহ্নিত। এ ছাড়া গৃহস্থালির কাজ ও অন্যান্য উৎস থেকে বায়ুদূষণের হার ৯ শতাংশ করে। বর্জ্য পোড়ানো থেকেও ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ হতে পারে। এসব ধুলোবালির দূষিত অংশ বাতাসের নিম্নস্তরে ২০০-৩০০ ফুট ওপরে অবস্থান করে। রাজধানী ঢাকার বাতাসে মিশ্রিত আছে নানা ধরনের সূক্ষ্ম রাসায়নিক বস্তুকণাসহ কার্বন-ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার, অ্যামোনিয়া ও ফটো-কেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। এসব ক্ষতিকর উপাদানগুলোর ব্যাপক হারে নিঃসরণ শহরে বসবাসকারী বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ।

ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনাতে নিঃসরণ মানমাত্রা এবং এনার্জি ট্রান্সজিশন এর সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত রয়েছে। আমরা যদি শুধুমাত্র উৎপাদন ক্ষমতার দিকে মনোযোগী হই, দূষণ নিয়ন্ত্রণের শক্তিশালী ব্যবস্থা না করি কিংবা আমাদের সুন্দর একটি মাস্টার প্ল্যানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত রাখি, সেক্ষেত্রে এটি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই, সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনাতে দূষণ হ্রাসের অনুশীলন সমন্বয়, কঠোর নিঃসরণ বিধিমালা এবং ক্লিন এনার্জি ট্রান্সমিশন এর বিষয়টি স্পষ্ট অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ধরিত্রী কুমার সরকার বলেন, আমাদের দেশে জ্বালানি নিয়ে বিভিন্ন সময় একাধিক পলিসি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পলিসিগুলোর মধ্যে অনেকাংশে সামঞ্জস্য থাকে না। আমাদের সমন্বিতভাবে একটি কার্যকরী পলিসি প্রণয়ন করতে হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, বায়ুদূষণ রাতারাতি কমানো সম্ভব নয়। তবে বায়ুদূষণের কারণে সৃষ্ট জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার কাজ করছে। ঢাকায় মানুষ বায়ুদূষণে অসুস্থ হবে, মারা যাবে আর বাসগুলো দূষণ করবে এটা চলতে দেয়া হবে না। পুরোনো বায়ুদূষণকারী বাস তুলে স্ক্র্যাপ করা হবে। কিছু মানুষের স্বার্থে ঢাকার সব বাসিন্দাকে বায়ুদূষণের শিকার হতে দেওয়া যাবে না। বাস মালিকদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।