বাংলাদেশের তারুণ্যের দক্ষতা ও কর্মসংস্থানেই দেশের অর্থনীতির মুক্তি বলে মনে করেন জনশক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখ্যক তরুণ কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে পাড়ি জমালেও প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। তাই দক্ষতা নিয়ে বিদেশে গেলে দেশের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে তারুণ্যকে দক্ষ করে প্রবাসে পাঠিয়ে অনেক বেশি রেমিটেন্স অর্জন সম্ভব বলে মত দেন তারা। আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তারা এসব মত দেন। এদিকে র‌্যালি এবং আলোচনাসহ নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস।

বলা হচ্ছে, দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এখন সারা বিশে^ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জনশক্তি রপ্তানি খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণসঞ্চার করেছে। খাত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে নিত্যনতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করে ব্যাপকহারে আরও জনশক্তি রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করার পথ সুগম করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং কর্তৃপক্ষকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। শ্রমিকরা যাতে প্রতারণার শিকার না হয় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৩ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ১১ মাসে ৬ লাখ ৭০ হাজার ৭৪৯ জন বাংলাদেশী নাগরিক সৌদি আরবে কাজের জন্য গেছেন এবং কাতার গেছেন ১ লাখ ৪৩৯ জন। এছাড়া, সিঙ্গাপুরে ৬৪ হাজার ৩২৬ জন বাংলাদেশীর কর্মসংস্থান হয়েছে।তিনি বলেন, আমরা বৈদেশীক অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরো জানান, সরকার দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের জন্য রাশিয়া, ব্রুনাই এবং পূর্ব ইউরোপসহ কিছু নতুন গন্তব্য অনুসন্ধান করছে।

এদিকে রেকর্ডসংখ্যক শ্রমিক বিদেশে গেলেও বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের বাস্তব চিত্র খুব একটা বদলায়নি। একক বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, আকাশছোঁয়া অভিবাসন ব্যয়, দুর্বল সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং অদক্ষ শ্রম রপ্তানির পুরোনো চক্রÑসব মিলিয়ে দেশের শ্রম রপ্তানি ব্যবস্থা এখনো ভঙ্গুরই রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করতে গেলেও এই প্রবণতার ভেতরে লুকিয়ে আছে বড় ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, সরকারকে প্রয়োজনভিত্তিক দক্ষ জনশক্তি; যেমনÑ নার্স, চিকিৎসক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মী গড়ে তুলতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কারণ, ভবিষ্যতে অনেক দেশে তাদের চাহিদা বাড়বে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন জেলায় বহু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করেছে, যাতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয়। এসব প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছেÑ জাহাজ নির্মাণ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা, রেফ্রিজারেশন ও এয়ার-কন্ডিশনিং, সাধারণ মেকানিক্স, বৈদ্যুতিক যন্ত্র রক্ষণাবেক্ষণ, অটো ক্যাড ২ডি ও ৩ডি, ওয়েল্ডিং (৬জি), ক্যাটারিং, রাজমিস্ত্রি এবং কোরিয়ান, আরবি, জাপানি ভাষা শিক্ষাসহ আরো অনেক কিছু। এরপরও প্রবাসে যে সমস্ত শ্রমিক কাজ করছে তাদের ৯৮ ভাগই অদক্ষ। বর্তমানে বছরে ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাচ্ছে সরকার জনশক্তি রপ্তানি খাত থেকে। এই অর্থ কয়েকগুণ করা সম্ভব যদি দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করা যায়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ডাক্তার এবং নার্সের যে চাহিদা রয়েছে সে চাহিদা পূরণে বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার নার্স পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারলে জনশক্তি রপ্তানির আয় সহজেই বাড়ানো যায়।

বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, হচ্ছে সুপারিশ বিদেশে যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি বা ‘আদম ব্যাপারির’ খপ্পর থেকে বিদেশগামীদের রক্ষা করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। যেখানে বিদেশে যেতে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা খরচ হওয়ার কথা সেখানে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয়া হয়। এই বাড়তি টাকার মাশুল গুনতেই প্রবাসীদের অনেক বছর লেগে যায়। বর্তমানে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতার, ওমান, কুয়েত, ইরাক, লিবিয়ায় ডাক্তার-নার্সদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিককালে সৌদি সরকার সে দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরে ব্যাপক বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকা- করছে। ফলে চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশ ডাক্তার-নার্স নেওয়ার জন্য ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, নেপালের মতো দেশের দিকে ঝুঁকছে। অথচ এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় এই দক্ষ জনশক্তির বাজার ধরতে পারত।

মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ জনশক্তির যে বাজার সৃষ্টি হয়েছে সে সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য অবশ্যই তৎপরতা চালাতে হবে। এতে একদিকে বিদেশে দেশের ডাক্তার-নার্সদের কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে বৈদেশীক মুদ্রা অর্জনও বৃদ্ধি পাবে। আর বৈদেশীক মুদ্রা অর্জন যত বাড়বে দেশের জন্য তা ততই মঙ্গল। সরকার দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির জন্য সারাদেশে ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে দেশে ৩৭টি সরকারি ও ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এসব মেডিকেল কলেজ থেকে বছরে ৫ হাজার ডাক্তার বের হচ্ছে। পাশাপাশি দেশে প্রায় ১০ হাজার নার্স বেকার রয়েছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তার-নার্সদের কর্মসংস্থানে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ কর্মী নিয়োগের প্রয়োজন হবে। অভিবাসন ব্যয় কমলে মালয়েশিয়ায় যেতে একজন শ্রমিকের সর্বসাকল্যে খরচ হবে অনেক কম। খরচ কম হওয়ায় তিন বছরে একজন শ্রমিক তা পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু দালাল চক্র বা মধ্যস্বত্ব ভোগীদের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ হলে অভিবাসন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। এতে একজন শ্রমিক বিদেশ যেতে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে। এই টাকা উঠাতেই তাদের কয়েক বছর লেগে যায়।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠায়, এটি সরকারের দাবি হলেও ৯০ শতাংশের বেশি কর্মী যান গুটিকয়েক দেশে। বিএমইটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালে বিদেশে গেছেন ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন কর্মী। এর মধ্যে সৌদি আরব যান ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জন। ২০২৩ সালে মোট কর্মী রপ্তানি হয় ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন; সৌদি আরব যান ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৪ জন। গত বছর মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৯৬৩ জনের মধ্যে সৌদি আরব গেছেন ৬ লাখ ২৮ হাজার ৫৬৪ জন। গত এক বছরে মালয়েশিয়া, ইউএই এবং ওমান তাদের শ্রমবাজার বন্ধ করে দিয়েছে। কাতার, কুয়েত এবং সৌদি আরব বাংলাদেশী কর্মী নিয়োগ কমিয়েছে। এ অবস্থায় অভিবাসন খাতের পতন ঠেকাতে প্রচলিত বাজার পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি নতুন বাজার সৃষ্টির দিকে সরকারের নজর বাড়াতে হবে। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কর্মী পাঠানো হয়েছে। গত কয়েক বছরে যারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগ কম বেতনে কাজ করছেন। গত কয়েক বছরে সৌদি আরবে কর্মীদের বড় একটি অংশ গেছেন ফ্রি ভিসায়। তাদের কাজের কোনো চুক্তি নেই, কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তাও নেই। কাজ জোগাড় করে নিতে হয়। বেশি কর্মী যাওয়ায় দেশটিতে কাজের সুযোগ কমেছে।

বিএমইটি সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৪৬ জন বাংলাদেশী নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা ২০২৩ সালে ২১ হাজার ৯৪২ দশমিক ৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২৪ সালে ২৬ হাজার ৮৯০ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০২৫ সালের জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন।

রিক্রুটিং এজেন্সি এবং অভিবাসী শ্রমিক অধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, মালয়েশিয়ার মতো কিছু ঐতিহ্যবাহী গন্তব্যে বৈদেশীক কর্মসংস্থান কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। তবে, নতুন বৈদেশীক চাকরির বাজার চিহ্নিত করা এবং কয়েকটি দেশে বাংলাদেশী শ্রমশক্তির উচ্চ চাহিদা বাংলাদেশকে জনশক্তি রপ্তানিতে ভালো অবস্থানে রাখতে সহায়তা করেছে।

রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, শ্রমিকের কাঁধে সবচেয়ে বড় বোঝাÑঅভিবাসন ব্যয় বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য এখনো অভিবাসনের সবচেয়ে বড় সমস্যা অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়। তিনি বলেন, 'সরকার ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করলেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অতিরিক্ত টাকা নেওয়া সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, 'এই সমন্বয়হীনতাই বাংলাদেশকে নিম্নমূল্যের শ্রম রপ্তানির ফাঁদে আটকে রেখেছে।' তিনি আরও জানান, নার্সিং ও কারিগরি পেশায় বড় সুযোগ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নার্সিং ডিগ্রি দিতে না পারায় সেই সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ব্র্যাক ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, অনিয়ন্ত্রিত দালালদের কারণে একই বাজারে যেতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের নেপালি শ্রমিকদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়। তিনি বলেন, 'বিমানবন্দরে হয়রানি কমানো জরুরি। শুধু লাউঞ্জ করলেই সমস্যা মেটে না। শ্রমিকেরা চান ঝামেলাহীন অভিজ্ঞতা, বাহ্যিক সাজসজ্জা নয়

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এখনো কম দক্ষ শ্রমিক রপ্তানি করছে স্বল্প মজুরির বাজারে। বিএমইটির প্রশিক্ষণগুলো স্বল্পমেয়াদি, দুর্বলভাবে স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে দক্ষ শ্রম অভিবাসনের একটি ধারাবাহিক পথ তৈরি হয়নি।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও বুধবারের ভাষণে জানান, দালালবেষ্টিত অভিবাসন জগতে প্রতারণা থামেনি। একের পর এক দেশে জনশক্তি রপ্তানির দরজা বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হওয়ার মূল কারণ জালিয়াতি। দেশের তারুণ্য অপার সম্ভাবনাময়। তরুণদের দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে পারলে তা জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক হবে। সে পথে এগিয়ে যেতে বাধা অতিক্রম করে জাতি হিসেবে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বানও জানান সরকার প্রধান।