জুলাই সনদ ও পিআর ইস্যু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও সরগরম। এরই মধ্যে কয়েকটি দাবিতে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং খেলাফত মজলিস একযোগে অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তাদের প্রধান দাবির মধ্যে রয়েছে জুলাই জাতীয় সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং সংখ্যানুপাতিক বা পিআর (প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন) পদ্ধতি প্রবর্তন। ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী আজ বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলন শুরু হবে। প্রথম দিন ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে, ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মসূচি পালিত হবে।
আন্দোলনের ন্যায্যতা তুলে ধরে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, জুলাই সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া ছাড়া অভ্যুত্থানের অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তার দাবি, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদ পিআর পদ্ধতির পক্ষে মত দিয়েছেন। জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই দাবিগুলো মানা না হলে তারা বৃহত্তর আন্দোলনে নামবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, আন্দোলন কেবল ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সারা দেশে বিস্তৃত হবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, দাবি পূরণ না হলে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদের বলেন, জুলাই জাতীয় সনদকে আইনগত ভিত্তি দিতে হবে এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হবে। তিনি দাবি করেন, দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ পিআর পদ্ধতির পক্ষে, তাই নির্বাচনে এই ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসলামপন্থি দলগুলোর এ ধরনের অভিন্ন কর্মসূচি মাঠে আন্দোলনের নতুন ধারা সৃষ্টি করবে। পিআর পদ্ধতির দাবি নতুন নয়, অতীতেও বিভিন্ন দল এ দাবি তুললেও বাস্তবে কোনো সরকার তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি। জানা গেছে, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি দল শেষ মুহূর্তে অংশ নিতে পারে।
সূত্র মতে, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ তীব্র হচ্ছে। ইসলামপন্থি দলগুলো নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার চেষ্টা করছে। জুলাই জাতীয় সনদ, পিআর পদ্ধতি ও নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে দাবিগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অভিন্ন কর্মসূচি শুধু রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবে নাকি নির্বাচনের মাঠে বাস্তব পরিবর্তন আনবে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, আগামী কয়েক মাসেই এ প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হবে।
সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন এবং ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ বাস্তবায়ন ও সেটির ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজন করা না করা ইস্যুতে নতুন করে বিবাদ দেখা দিয়েছে রাজনীতিতে। ঐকমত্য কমিশন যখন জুলাই সনদ স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছে, তখনই এই দুটি ইস্যুতে সংশ্লিষ্ট দল-জোটগুলোর মধ্যে প্রকট মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস এবং মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সংসদের উচ্চ ও নি¤œ উভয় কক্ষেই পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি নতুন করে সামনে এনেছে। উপরোক্ত চারটি দলের সঙ্গে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। এর আগে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।
এবিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বিষয়গুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা হবে। সময় আছে, আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। তিনি বলেন, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হতে হবে। নইলে শুধু অভ্যন্তরীণ জাতীয় নিরাপত্তা নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়বে।
দলগুলোর এই যুগপৎ কর্মসূচিকে নির্বাচনী রাজনীতি মাঠে গড়ানোর ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার কেউ কেউ এটাকে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা বা বোঝাপড়ার আভাস হিসেবেও দেখছেন। সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজনসহ চার-পাঁচটি অভিন্ন দাবিতে প্রাথমিকভাবে আটটি দল যুগপৎ কর্মসূচি শুরুর বিষয়ে একমত। বাকিরা সময় সুযোগ নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।
সূত্র মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। এই সনদের ‘চূড়ান্ত ভাষ্য’ ইতোমধ্যে দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে কমিশন। গত জুলাই মাসে এই সনদ সই করার লক্ষ্য ছিল। তবে বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় সনদ আটকে আছে। অবশ্য বাস্তবায়নের পদ্ধতি জুলাই সনদের অংশ হবে না। এবিষয়ে সরকারকে আলাদা সুপারিশ দেবে ঐকমত্য কমিশন। বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক একাধিক বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক হয়েছে। এবিষয়ে দলগুলোর কাছ থেকে লিখিত মতামতও নেওয়া হয়েছে। সংবিধান সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আগামী জাতীয় সংসদ গঠনের দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের পক্ষে বিএনপি। জামায়াতে ইসলামী সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের মাধ্যমে আর এনসিপি গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন চায়। এর বাইরে বেশকিছু দল সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স নিয়ে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে।
তবে মাসের পর মাস আলোচনার পরও সংস্কার ইস্যুতে মতৈক্য না হওয়ায় আবার মাঠে গড়াচ্ছে আন্দোলন। সংস্কার প্রশ্নে দফায় দফায় বৈঠক করেছে ঐকমত্য কমিশন। তবে আলোচনার শেষদিকে এসেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি দলগুলো। বরং সংবিধান-সংক্রান্ত সংস্কার এবং বহুল আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো বিস্তৃত আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘিরে দেশে যে রাজনৈতিক পরিম-ল গড়ে উঠেছিল, তা এখনো পুরোপুরি স্থায়ী ঐকমত্যে রূপ নিতে পারেনি, যে কারণে মাঠের আন্দোলন বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বৃহত্তর স্বার্থে ছোটখাটো বিষয়ে ছাড় দিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষক ও বিশিষ্টজন।
জানা গেছে, এমনিতেই সাম্প্রতিক বিভিন্ন ইস্যুতে কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফলে বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের পরাজয়ের পর দলটি চাপে পড়েছে কিনা, এমন প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে বিএনপির জন্য আগামী নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বেশ চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। কারণ ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের বড় পরাজয় ঘটেছে। ফলে নির্বাচন, পিআর বা জুলাই সনদ ইস্যুতে তারা আগের তুলনায় বিএনপির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হতে পারে। অবশ্য বিএনপি নেতারা বলছেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন এক নয়।
জামায়াতসহ কয়েকটি দলের নেতারা অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বিশেষ করে গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর থেকে সরকার বিএনপির চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে চলছে। এ অবস্থায় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন না করলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না এনসিপি। নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, এখন যে সংবিধান রয়েছে, সেটি আওয়ামী সংবিধান। এটি সংস্কার করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, মৌলিক সংস্কার, নতুন সংবিধান আর হাসিনার বিচার ছাড়া নির্বাচন হলে এনসিপি অংশ নেবে না। আর সেই নির্বাচন দেশের মানুষও মেনে নেবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, কিছু বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে ঐকমত্যে পৌঁছাতে এত লম্বা সময় নেওয়াটা ঠিক হয়নি। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও মনোমালিন্য বাড়ছে। যেহেতু দলগুলোর নিজস্ব স্বার্থের প্রতিযোগিতা আছে। মূলত ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘসূত্রতার কারণেই সংকট তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে অনতিবিলম্বে সংসদ নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। সে সঙ্গে দু-একদিনের মধ্যেই ঐকমত্য কমিশনকে দলগুলোর সঙ্গে বসে দ্রুততার সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
জানা গেছে, দেশের এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সমঝোতাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সময় দিতে চায় সরকার। এরই অংশ হিসেবে সমঝোতার জন্য আলোচনা অব্যাহত রাখতে ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আবারও বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তৃতীয় ধাপের সংলাপে জুলাই সনদের বিষয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, যে সমঝোতার রাস্তা শুরু করেছি, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সমঝোতায় আসতেই হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জুলাই সনদে উল্লিøখিত সুপারিশের মধ্যে যেসব সুপারিশ নির্বাহী আদেশ বা অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, সেগুলো নিয়ে দলগুলোর মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। কিন্তু সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এই ইস্যুতে যতই আলোচনা হচ্ছে, ততই নতুন নতুন দাবি ও প্রস্তাব সামনে আসছে। এ ক্ষেত্রে এখনই জুলাই সনদের সব সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং সনদের ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি প্রাধাণ্য পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জামায়াত সাংবিধানিক আদেশ জারি এবং এনসিপি গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব রেখেছে। এই অবস্থায় দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা না হলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের পাশাপাশি বড় ধরনের সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে।