কাশ্মীরে হামলার নেপথ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’

অধিকৃত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। পাকিস্তানের কাশ্মীরের নাগরিকদের দুই মাসের খাবার মজুদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং দেশটি অত্যাধুনিক অস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিও প্রদর্শন করছে। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় পর্যটক ছিলেন। এ ঘটনায় পাকিস্তান জড়িত বলে অভিযোগ করেছে চিরবৈরী ভারত। যদিও হামলার সঙ্গে কোনোরকম সংশ্লিষ্টতার দায় অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। এ হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) বরাবর সপ্তম দিনের মতো দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাবিনিময় হয়েছে। খবর জিও নিউজ, এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ও মার্কিন সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি), জিও টিভি, রয়টার্স ।

এদিকে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুটি দেশই সীমিত পরিসরে সামরিক হামলার আভাস দিচ্ছে। এতে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাবস্থার মধ্যে এশিয়াতেও একই পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে কোনোমতেই আরেকটি যুদ্ধ চাইছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এদিকে ভারতের সঙ্গে চরম উত্তেজনার মধ্যেই সামরিক মহড়া চালাচ্ছে পাকিস্তান। এই মহড়ায় দেশটি অত্যাধুনিক অস্ত্রের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন প্রস্তুতিও প্রদর্শন করছে। নিরাপত্তা সূত্রের বরত দিয়ে পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ শুক্রবার (২ মে) এ তথ্য জানিয়েছে। পূর্ণ সক্ষমতায় চালানো এই মহড়ায় হালকা ও ভারী দুই ধরনের অস্ত্রেরই ব্যবহার করা হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি ও পদাতিক ইউনিট। এছাড়াও ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ জড়িত; সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ্লিকেশন টেলিগ্রামে ‘ফাঁস হওয়া’ এক গোপন নথির উদ্ধৃতি দিয়ে চাঞ্চল্যকর এ দাবি করেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। তবে ওই নথিটি আসল কি-না, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। টেলিগ্রামে ফাঁস হওয়া গোপন নথির বরাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, পেহেলগামের ওই ঘটনাটিকে “অমুসলিম জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে চালানো হামলা” বলে প্রচার চালানোর সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। গতকাল শুক্রবার (২ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে পাকিস্তানী সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।

ভারত ও পাকিস্তান বহু বছর ধরেই পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। তবে দুই দেশেরই দাবি তাদের অস্ত্রগুলোর উদ্দেশ্য যুদ্ধ শুরু করা নয়; বরং প্রতিরোধ করা। এক্ষেত্রে ভারতের নীতি হলো ‘প্রথমে ব্যবহার না করা’। তার মানে, ভারত কেবল তখনই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে, যখন তাদের সেনাদের ওপর বা ভারতের ভূখণ্ডের ওপর পারমাণবিক হামলা হবে। অন্যদিকে পাকিস্তানের নীতি হলো ‘ফুল স্পেকট্রাম ডিটারেন্স’ বা সম্পূর্ণ পরিসরে প্রতিরোধ কৌশল। ভারতের মতো বড়, শক্তিশালী ও ধনী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর পারমাণবিক বা গতানুগতিক সামরিক হামলার মোকাবিলায় পাকিস্তানের এই প্রস্তুতি। তবে প্রথমে ব্যবহার না করার নীতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে পাকিস্তানে। দেশটি মনে করে যে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে, সেক্ষেত্রে তারা প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়নি। এপির প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের তুলনায় কম সামরিক শক্তির কারণে পাকিস্তান বাস্তবিক অর্থে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার ক্ষমতা রাখে না বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনো দেশই কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানে না অপর দেশের কাছে ঠিক কি পরিমাণ বা কী ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ১৯৭৪ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় ভারত। এদিকে, পাকিস্তান প্রথম পরীক্ষা করে ১৯৮৮ সালে।

বিভিন্ন থিংকট্যাংকের মতে, পাকিস্তানের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে, আর ভারতের প্রায় ১৭২টি। অবশ্য কিছু বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অস্ত্রসংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, প্রায় ২০০টি হতে পারে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেশী এই দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতা থাকা সত্ত্বেও দুই দেশের পারমাণবিক স্থাপনা ও অবকাঠামোগুলোতে হামলা পরিচালনা না করার জন্য তারা ১৯৮৮ সালে একটি চুক্তি করে। ১৯৯১ সালে এ চুক্তি কার্যকর হয়। চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশ প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে পরস্পরকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনার তথ্য সরবরাহ করবে। ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুই দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের প্রথা শুরু হয়। এরপর থেকে তারা টানা ৩৪ বছর ধরে এই তালিকা বিনিময় করেছে। তবে, ভারত-পাকিস্তান কেউই আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ প্রতিরোধ চুক্তিতে সই করেনি। এই চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিস্তার ঠেকানোর উদ্দেশ্যে গঠিত।

কাশ্মীরে হামলার নেপথ্যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’: পাকিস্তানী সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়েছে, পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে জড়িয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াতে ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ রয়েছে ওই নথিতে। বেশ কয়েকটি সূত্রের বরাতে দাবি করা হয়েছে, ফাঁস হওয়া নথিটি প্রমাণ করে যে ভারতীয় সরকারও পেহেলগাম হামলায় জড়িত। নথিতে দেওয়া নির্দেশনা এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যে যে গড়মিল হয়েছে, তা থেকেই এই “ফলস ফ্ল্যাগ” হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থাৎ ভারত নিজেই এই হামলা সাজিয়েছে যেন পাকিস্তানের ওপর দোষ চাপানো যায়।

নথিতে বলা হয়েছে, হামলার ৩৬ ঘণ্টা পরে পাকিস্তানবিরোধী প্রচার চালানোর জন্য মিডিয়াকে নির্দেশনা দেওয়া হবে। তবে, মিডিয়া হামলার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানকে দায়ী করে বসে, যার ফলে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সূত্রগুলো বলছে, এই নথি এবং তাতে থাকা বৈপরীত্য প্রমাণ করে যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কেও অন্য কোনো মহল থেকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া নথিটি এভাবে প্রকাশ হওয়াটাই ‘র’-এর ভেতরে বিদ্যমান হিন্দুত্ববাদ বিরোধী মনোভাবের ইঙ্গিত দিতে পারে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আজাদ কাশ্মীরের নাগরিকদের দুই মাসের খাবার মজুদের নির্দেশনা: পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীরের ভারত সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দাদের দুই মাসের খাবার মজুদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার জেরে সৃষ্টি হওয়া উত্তেজনার মধ্যে শুক্রবার (২ মে) এমন নির্দেশনা দেন আজাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী আনোয়ারুল হক। তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “সীমান্ত রেখার (এলওসি) কাছের ১৩টি নির্বাচনী এলাকার মানুষকে দুই মাসের খাবার মজুদ করতে বলা হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকাগুলোর মানুষের খাবার, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের যোগান নিশ্চিত রাখতে ১০০ কোটি রুপির ফান্ড গঠন করা হয়েছে।” আজাদ কাশ্মীরের রাস্তাঘাটগুলো ঠিক রাখতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি মালিকানাধীন যন্ত্রপাতিও সীমান্ত রেখার কাছে মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।