জুলাই অভ্যুত্থানে কতিপয় সদস্যের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে জণরোষে পড়ে পুলিশ বাহিনী। যে কারণে এবারের পুলিশ সপ্তাহ হবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। অবশেষে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরেদর মনবল বাড়িয়ে জন আকাঙ্খা পুরনে হচ্ছে পুলিশের সব চেয়ে বার্ষিক বড় আয়োজন পুলিশ সপ্তাহ। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানা গেছে, আগামি ২৯ এপ্রিল উদযাপন হচ্ছে পুলিশ সপ্তা- ২০২৫।

পুলিশ সদরদফতরের একজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা গতকাল বুধবার দৈনিক সংগ্রামকে জানান, এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশ সপ্তাহ হবে ভিন্ন আঙ্গিকে। গতানুগতিক ৭ দিনের পরিবর্তে এবারের পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠান হচ্ছে তিনদিনের। হচ্ছে না প্যারেড এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এবারের পুলিশ সপ্তাহে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস। তবে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবারও ছোট পরিসরে প্রদান করা হবে পুলিশ পদক। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শুরুতে ‘পুলিশ সপ্তাহ’ উদযাপন করে বাংলাদেশ পুলিশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের কারণে এবং ২০১৯ সালে পুলিশ সপ্তাহ হয় ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে। ২০২৪ সালেও একই কারণে পুলিশ সপ্তাহ পিছিয়ে হয় ফেব্রুয়ারিতে।

জানা গেছে এবার এখনও পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনের সিদ্ধান্ত ছিল না পুলিশ সদরদপ্তরের। পাঁচ আগস্টের পর সংগত কারণে পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে বাহিনীটির কোনো ইউনিটকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা পুলিশ সপ্তাহ উদযাপনে পুলিশ সদর দফতরকে অনুরোধ করায় এ অনুষ্ঠান উদযাপন করতে প্রস্তুতি নেয় সরকার। পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছরই পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একগুচ্ছ দাবি উত্থাপন করে পুলিশ। দাবি পূরণের আশ্বাসও দেন দেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। সেখানে প্রধান অতিথি ভাষণ দেন, সভাপতিত্ব করেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ চৌকস কর্মকর্তাদের বিপিএম ও পিপিএম প্রদান করেন প্রধান অতিথি।

গত বছর ৪০০ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম), বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-সেবা এবং রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)-সেবা দেওয়া হয়। গত বছরের পুলিশ সপ্তাহে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন পুলিশ সদস্যরা। দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে নিয়োগের পাশাপাশি, বিদেশি মিশনগুলোতে প্রেষণে পুলিশ অফিসারদের নিয়োগের দাবিও উত্থাপন করা হয়। এ ছাড়া নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, গাড়ি কিনতে সুদমুক্ত ঋণ ও পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঝুঁকি ভাতা, নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যদের জন্য সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি জট কমানোসহ পুরোনো দাবিগুলো ফের তুলে ধরা হয়।

যে কারণে দেরি করে পুলিশ সপ্তাহ : চাকরিতে কোটা সংস্কার প্রশ্নে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার কারণে বিতর্কিত হয় পুলিশ। যার প্রথম নজির স্থাপিত হয় রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর আন্দোলন দমাতে পুলিশের মারমুখী অবস্থান অতীতের সব সমালোচনাকে ছাড়িয়ে যায়। ছাত্রদের আন্দোলন গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণরোষের মুখে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায়। ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। তোপের মুখে পড়ে পুলিশ। থানা, ট্র্যাফিক স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশ সদস্যদের মারধর, এমনকি তাদের হত্যার ঘটনাও ঘটে। সরকার পতনের পর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে। ছাত্র-জনতার রোষের মধ্যে ডিএমপিসহ পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী এবং সরকার ও আওয়ামী ঘেঁষা সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যান। অনেকে হন গ্রেপ্তার। ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পুলিশি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখন নিজ নির্ভরতায় গতিশীল হচ্ছে পুলিশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মমতা, গুম কিংবা বিরোধী মত দমনে পুলিশকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে গত ১৫ বছর ধরে। যে কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাহিনীটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশকে পেশাদার, জনমুখী ও সেবাদানকারী সংস্থায় পরিণত করতে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। সেই সংস্কার প্রক্রিয়া যেহেতু শুরু হয়েছে, সংগত কারণে সংস্কার কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন ফরমেটে হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গতকাল বুধবার রাতে দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, প্রতিবছরের মতো এবার ব্যাপক ভাবে পুলিশ সপ্তাহ হচ্ছে না। এবার পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ছোট পরিসরে। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবারও পুলিশ পদক দেয়ার চিন্তা আছে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে। তবে তাদের নাম এখনো চুড়ান্ত হয়নি। প্রতি বছরই অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পুলিশ সদস্যদের বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার রহস্য উদঘাটন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দক্ষতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, সততা ও শৃঙ্খলামলূক আচরণের মাধ্যমে প্রশংসনীয় অবদানের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-সেবা এবং রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)-সেবা পদকে ভূষিত করা হয়।