চলতি মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ প্রস্তুত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে আসার বিষয়েও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের একাদশতম দিনের আলোচনার শুরুতে এসব কথা বলেন তিনি। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের মতানৈক্য নেই। সবাই একই উদ্দেশ্যে কাজ করছে এবং এ মাসের মধ্যেই জুলাই সনদ প্রস্তুত সম্ভব হবে’ বলেন আলী রিয়াজ।
যে সব বিষয়ে আলোচনা অগ্রসর হয়েছে, তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় কমিশন বলেও জানান এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ের দুমাসের আলোচনায় অনেক বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যা জাতীয় সনদ তৈরির ক্ষেত্র অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেছে। রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক বিষয়গুলোতে একমত হওয়া প্রয়োজন। বলেন, ‘রাষ্ট্রকে এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে কখনো ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরে না আসে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৃহস্পতিবারের আলোচনায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। আলোচনায় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত আছেন বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। ১১তম দিনের আলোচনায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণাÑএ তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন বললেন : বিএনপির স্থায়ী কামিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘একটি রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার মধ্যস্থতাকারীর দায়িত্ব নিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা এখনই সুনির্দষ্টি করে কিছু বলতে চাই না। তবে আমরা ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করতে চাই। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে চাই। এ বিষয়ে সরকারকে লিখিত প্রস্তাবনাও দেওয়া হয়েছে। সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর জনপ্রতিনিধিরা ঘোষণাপত্র তৈরি করেছিলেন, তারা আলোচনা করে সংবিধান প্রণয়ন করেন। তবে পরবর্তী সময়ে ঘোষণাপত্রকে সংবিধানে সংযুক্ত করা হয়নি।
তিনি মনে করেন, ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকার বিধান নেই। তিনি জানান, জুলাই ঘোষণাপত্রের একটি প্রস্তাবনা বিএনপির কাছে দিয়েছে সরকার। এ নিয়ে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনাও হয়েছে। এটি নতুন করে ড্রাফট দেওয়া হয়েছে। তবে সে ব্যাপারে এখনই বিস্তারিত বলে গোপনীয়তা ভঙ্গ করতে চান না তারা।
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ : প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ দুজনের মধ্যে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের পক্ষে বিএনপি। তবে এ বিষয়ে পুরোপুরি ঐকমত্য তৈরি হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগকে বাইরে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে সবাই একমত। তবে কাদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হবে, তা নিয়ে এক হওয়া যায়নি।’ দলীয় ফোরামে আলোচনা করে উচ্চকক্ষের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা আরও ফলপ্রসূ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
‘জরুরি অবস্থা’ ইস্যু : জরুরি অবস্থা জারির বিষয়ে ‘প্রধানমন্ত্রীর’ পরিবর্তে ‘মন্ত্রিপরিষদের’ অনুমোদন নেওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘জীবনের নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও বিষয় ক্ষুণ্ন করা যাবে না, সে বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসেবে রাখতে চাই আমরা। আর এই আইন যাতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে সবাই একমত। তবে কোনও প্রক্রিয়ায় কারা সিদ্ধান্ত নেবেন তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।’
অপরদিকে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দের পরিবর্তে ‘বিলুপ্তির প্রস্তাবে’ বিএনপি একমত বলেও জানান সালাহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘তবে যুদ্ধ এবং বহিঃআক্রমণ ছাড়া আরও কিছু বিষয় যুক্ত করার পক্ষে। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়লে অথবা প্রাকৃতিক মহামারি হলেও জরুরি অবস্থা চায় বিএনপি।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, আমাদের সংবিধানের আর্টিকেল ৪৮/৩ প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রের সমস্ত কার্যক্রমের নির্বাহী অধিকারী। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবেই রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। আমরা বলেছি, এটা সংশোধন করে অ্যাপিলিয়েট ডিভিশনের জ্যৈষ্ঠতার আলোকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। এটাও নীতিগতভাবে ঐকমত্য হয়েছে। তবে জ্যৈষ্ঠতার মধ্যে একজন অথবা দুইজনের মধ্য থেকে হতে পারে। আমরা জামায়াতের পক্ষ থেকে বলেছি একজনের মধ্য থেকে হতে হবে। একথা আরও অনেকের পক্ষ থেকে হতে হবে। কোন কোন দলের পক্ষ থেকে দুজনের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বিতীয় এজেন্ডা ছিল জরুরী অবস্থা জারি করা। আজ ঐকমত্য কমিশন দুটি আর্টিকেল সামনে এনেছে। অ্যামেন্ডমেন্ট করা। আমরা তাতে একমত হয়েছি। বর্তমানে যা রয়েছে তা ব্যবহার হয় রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে। এক্ষেত্রে জরুরী অবস্থা যেন রাজনৈতিক হাতিয়ার না হয়। তার মধ্যে কিছুটা অমীমাংসিত রয়েছে। মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়। জরুরী অবস্থা জারি হলে মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে কমিশন বলেছে, জীবন বাঁচানোর অধিকার সুরক্ষা করা। আরেকটা মর্যাদা রক্ষা করা, নিষ্ঠুর আচরণ এবং কোন অমানবিক আচরণ যেন না করা হয় তা নিশ্চিত করা। আমরা এই দুটোতেও একমত হয়েছি। আরেকটি হচ্ছে বিচার প্রাপ্তির অধিকার। সেটা আইনে থাকলেও স্বৈরাচারি সরকার আইন লংঘন করে। তাই সেটা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা রাখার কথা আমরা বলেছি। প্রেসিডেন্ট নিয়োগের পাওয়ারটা একজন ব্যক্তির হাতে না দিয়ে একাধিক সুপারিশ যেন থাকে। ঐকমত্য কমিশন সুপারিশ করেছে, দুটি সুপারিশে হবে। বিদ্যমান আইনে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে হয়। সংসদের প্রথম দিনেই সংসদীয় কমিটি হবে। সেই কমিটির সুপারিশে রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করবেন। যদি প্রয়োজন দেখা দেয়।