জ্বালানির দাম বাড়লেও বিপিসির লাভ ২ ০৫০ কোটি টাকা

নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনায় হতাশ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত গুরুত্ব পায়নি বরং ফসিল ফুয়েল নির্ভরতা আরও বাড়ানো হয়েছে।

বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এছাড়া খাত সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর যে আর্থিক সংকট তা উত্তরণে কোনো পদক্ষেপ বাজেটে প্রতিফলন ঘটেনি বলেও জানানো হয়। এক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ গ্যাস আহরণের চেয়ে এলএনজি আমদানি নির্ভরতা দেশের জ্বালানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এজন্য গ্যাসকূপ খনন করার তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: জ্বালানি রূপান্তরের অগ্রাধিকারের ওপর প্রতিফলন’ শীর্ষক সিপিডির আলোচনায় এসব কথা বলা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-ইরান উত্তেজনাসহ সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। এতে আগামী অর্থবছরে বিপিসির মুনাফার পরিমাণ কমে ৬১৫ কোটি টাকায় নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সিপিডি।

স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থার আওতায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা লাভ করেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত ‘২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত: জ্বালানি রূপান্তরের অগ্রাধিকারের প্রতিফলন’ শীর্ষক বৈঠকে এ তথ্য জানায় সিপিডি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যোগ দেন জ্বালানি উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফৌজুল কবির খান। এ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ভোক্তা অধিকার সমিতির (ক্যাব) সহসভাপতি অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহসভাপতি ব্যারিস্টার বিদ্যা অমৃত খান, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মনোয়ার মোস্তফা এবং বিকেএমইএ’র সহসভাপতি মো. আখতার হোসেন অপূর্ব।

সিপিডি জানায়, শুধু বিপিসি নয়, পেট্রোবাংলার অধীন দুটি প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ও আরপিজিসিএল-ও ২০২৪–২৫ অর্থবছরে লাভ করেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী, বাপেক্সের মুনাফা হয়েছে ১৩৭ কোটি টাকা এবং আরপিজিসিএলের মুনাফা ৪১ কোটি টাকা। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে এই অর্জিত হয়।

সিপিডির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বাপেক্সের মুনাফা বেড়ে ২৫৮ কোটি এবং আরপিজিসিএলের মুনাফা ৪৯ কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারে। এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট মওকুফ এবং গ্যাসের দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনার মুখে এমন প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বিপুল লোকসানের মুখে রয়েছে। সিপিডি বলছে, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বিপিডিবির লোকসান হয়েছে ৮ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা এবং আগামী অর্থবছরে লোকসান বেড়ে ৯ হাজার ৪৩ কোটি টাকায় দাঁড়াতে পারে।

সিপিডির এই সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বাজেট অন্তর্বর্তী সরকারের তিন শূন্য অঙ্গীকার দারিদ্র্য শূন্য, নিঃসরণ শূন্য ও বেকারত্ব শূন্য বিশেষ করে ‘নিঃসরণ শূন্য’ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।এ ছাড়া, জরুরি সংস্কার ছাড়া বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তরে আরও পিছিয়ে পড়তে পারে বলেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি।

জ্বালানি রূপান্তরের লক্ষ্য পুনরুদ্ধারে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি। এরমধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে কর ছাড় বাতিল করা, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে কার্বন কর ও শুল্কারোপ, জীবাশ্ম জ্বালানি ও এলএনজির সকল ভর্তুকি তুলে নেওয়া, গ্যাস উন্নয়ন তহবিল ব্যবহার করে ঘরোয়া গ্যাস অনুসন্ধান অগ্রাধিকার দেওয়া, অদক্ষ বিদ্যুৎকেন্দ্র ধাপে ধাপে বন্ধ করা, আগাম অনুমোদনপ্রাপ্ত স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী চুক্তি পুনরায় আলোচনার মাধ্যমে পরিমার্জন করা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং আমদানিকৃত সরঞ্জামে শুল্ক ও ভ্যাট কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য একটি ভর্তুকি তহবিল তৈরি, স্মার্ট গ্রিডে বিনিয়োগ বাড়ানো-যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে সহজে যুক্ত করা যায়, স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিবর্তে স্বল্প সুদের বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়ন চাওয়া এবং ২০৪০ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি পর্যালোচনা করা।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সহযোগী গবেষক হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী। উপস্থাপনকালে তিনি বলেন, ‘‘শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব ও শূন্য কার্বন নিঃসরণ-এই তিন লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা এখনও ‘২.৫০ শূন্যে’ আছি। কারণ বাজেটে এখনও ফসিল ফুয়েল প্রাধান্য পাচ্ছে, এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট ছাড় দেয়া হয়েছে, কিন্তু নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে কোনো প্রণোদনা নেই।’’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার মাত্র ৭টি প্রকল্পে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি হলেও প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ কম। বাজেটে ৭০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিলের কথা বলা হলেও সেটি যথেষ্ট নয়।’

সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘পূর্ববর্তী সরকার জ্বালানি খাতে বিপুল ব্যয় করেছে, যার মাধ্যমে জ্বালানির প্রাপ্যতা বেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে দেখা গেছে দুর্নীতি ও অপচয়। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা, তারা সুশাসনকে গুরুত্ব দেবে এবং জ্বালানির রূপান্তরে কার্যকর উদ্যোগ নেবে।’