জরুরি অবস্থাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার রোধে একমত রাজনৈতিক দলগুলো
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, ‘গত বছরের জুলাই-আগস্টে শহীদদের প্রতি আমাদের যে দায়িত্ববোধ আছে, তার প্রেক্ষিতে আমরা ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে একটি যৌক্তিক জায়গায় পৌঁছাতে চাই। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলো জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার রোধে নতুন বিধান তৈরিতে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।
গতকাল রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১২তম দিনে ঐকমত্যে পৌঁছায় দলগুলো। এর আগে সকাল ১১টায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই আলোচনা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
এদিনের আলোচনার সূচিতে প্রাধান্য পায়- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগবিধি ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা। বরাবরের মতো আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। এছাড়া, কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
সংলাপ শুরু হওয়ার আগে সূচনা বক্তব্যে কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, যেহেতু আপনারা রাজনৈতিক দল করেন, সেহেতু সব বিষয়ে আপনাদের একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আপনাদের প্রতি অনুরোধ, একটি মাঝামাঝি স্থানে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে। পরবর্তীতে যদি জনগণের কাছ থেকে আপনারা প্রতিনিধিত্ব লাভ করতে পারেন, তাহলে সেটি পরিবর্তন করতে পারেন এবং সেটি জনগণের রায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। কিন্তু কমিশন মনে করছে, একটি পর্যায়ে আসা ভালো।
তিনি আরও বলেন, আমরা আপনাদের বক্তব্যকে গুরুত্বহীন মনে করছি না, বরং আমরা চাচ্ছি সকলে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাক। চাইলেই এই আলোচনা বাদ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু তাতে বিদ্যমান পরিস্থিতিই থেকে যাবে। আমাদের একটি জায়গায় আসতে হবে- এই বিবেচনাটা যদি আপনারা করেন, তাহলে আমাদের পক্ষে ঐকমত্য গঠন করা সম্ভব।
তিনি সকলের প্রতি কিছুটা ছাড় দিয়ে ও কিছুটা অবস্থান পরিবর্তন করে একটি জায়গায় আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা অবস্থার পরিবর্তন করে হলেও এগিয়ে আসুন। না হলে আমরা যেখানে আছি, সেখানেই থেকে যাব। গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে এইটুকু বিবেচনা করুন যে, এটা সম্ভব কি না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৪১(ক) এর ১ নম্বর ধারায় বর্তমানে উল্লেখ রয়েছে- যদি রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয়, যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ কিংবা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কারণে বাংলাদেশ বা তার কোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন হুমকির মুখে পড়েছে, তবে তিনি অনধিক ৯০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে এই ঘোষণা দেওয়ার আগে মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে। বর্তমান সংবিধানে এই সময়সীমা ১২০ দিন।
প্রস্তাবনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার বৈধতার শর্ত হিসেবে পূর্বে যে ‘প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর’ প্রয়োজনীয় ছিল, তা পরিবর্তন করে ‘মন্ত্রিসভার সম্মতি’ গ্রহণের বিধান যুক্ত করা হবে।
এই বিষয়ে ৭ ও ১০ জুলাই অনুষ্ঠিত আলোচনার ভিত্তিতে গতকাল রোববারের সংলাপে সিদ্ধান্ত হয়, ১৪১(ক) অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দটি বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত হুমকি’- এই শব্দগুলো অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকের দুটি মৌলিক অধিকারকে অলঙ্ঘনীয় হিসেবে বিবেচনায় আনার বিষয়ে সংলাপে গুরুত্বারোপ করা হয়। সংবিধানের ৪৭(৩) ধারা অনুযায়ী, জরুরি অবস্থার সময়েও কোনো নাগরিকের জীবনধিকার এবং নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও মর্যাদাহানিকর আচরণ বা শাস্তি থেকে মুক্ত থাকার অধিকার খর্ব করা যাবে না। সংলাপে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত দেখা যায়।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মন্ত্রিসভার পরিবর্তে সর্বদলীয় বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আহমদ আবদুল কাদের মন্ত্রিসভার সঙ্গে বিরোধী দলকে যুক্ত করা প্রস্তাব দেন। আলোচনার এক পর্যায়ে জরুরি অবস্থা নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা নেত্রীর উপস্থিতি নিশ্চিতের প্রস্তাব করেন জামায়াতের নায়েবে আমীর সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ প্রস্তাবে সমর্থন জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরে ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বিরোধী দলীয় নেতা না থাকলে কে উপস্থিত থাকবেন তা নিয়ে কথা বলেন। তিনি সে সুযোগ রাখার প্রস্তাব করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার জানান, বিরোধীদলীয় উপনেতাও মন্ত্রী পদমর্যাদার।
পরে সিদ্ধান্ত হয়, জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার অনুমোদনের বিধান যুক্ত করা। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বা নেত্রী বা তার অনুপস্থিতিতে বিরোধীদলীয় উপনেতা উপস্থিত থাকবেন।
বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, জরুরি অবস্থা জারিতে মন্ত্রিপরিষদ ও প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি বিরোধী দলীয় নেতা বা উপনেতার মতামত নিতে হবে। এরপর অধ্যাদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি। এ বিষয়ে বেশিরভাগ দলই একমত হয়েছে।
জামায়াতের নায়েবে আমীর বলেন, বিদ্যমান আইনে জরুরি অবস্থা জারি করেন প্রেসিডেন্ট। এতে শুধু স্বাক্ষর করেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা বলেছি, এক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ডেকে নিয়ে বিরোধী দলীয় প্রধানেরও মতামত নিতে হবে। কোনো কারণে তিনি অনুপস্থিত থাকলে বিরোধী দলীয় উপনেতার মতামত নিতে হবে। আর যদি তখন সংসদ কার্যকর না থাকে, তাহলে সর্বশেষ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সংসদের সরকার ও প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। অর্থাৎ সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত থাকতে হবে।
ডা. তাহের বলেন, আবার এই আইনের অপব্যবহার হলেও প্রতিবাদ করতে পারবেন বিরোধী দলীয় নেতা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। বিষয়টিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে জানান তিনি।
জামায়াতের নায়েবে আমীর বলেন, জামায়াত চায় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতিই হবেন প্রধান বিচারপতি। যদিও কয়েকটি দলের মতামত দুইজন বা তিনজনের প্যানেল থেকে একজনকে বাছাই করা হবে। আমরা মনে করি, এতে ফ্যাসিবাদের সমর্থকদের ঢুকে পড়ার সুযোগ হয়ে যেতে পারে। অথবা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে নিয়োগ হতে পারে। তিনি জানান, এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত একমত হওয়া যায়নি। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আলোচনা সম্পন্ন না হলেও আমরা চাই এটি যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।