আয়নাঘরে গুম করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল ইনশাআল্লাহ, ন্যায়বিচারই পাবেনÑ বিচারপতি
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ ১৩ আসামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে (জেআইসি) গুমের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এ আদেশ দিয়েছেন আদালত।
রাষ্ট্র ও আসামী পক্ষের শুনানি শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এর আগে জেআইসি গুমের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনা ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১৩ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষ হয়। শুনানি নিয়ে এ সংক্রান্ত বিষয়ে আদেশের জন্য গতকাল এ দিন ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল সেটি শুনানি ও আদেশ দেওয়া হয়েছে। তারও আগে গত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ দিন ঠিক করেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার শাইখ মাহদী। আসামীপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু, মাহিন এম রহমান, মাসুদ সালাউদ্দিন ও মো. আমির হোসেন।
এ মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগ পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের প্রথম সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ। অভিযোগ পড়া শেষে আসামীর কাঠগড়ায় থাকা তিন সেনা কর্মকর্তাকে নিজেদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বুঝেছেন কিনা জানতে চান। যদিও চার্জ গঠনের পুরো আদেশটি বাংলায় পড়ার জন্য আবেদন করেন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। তিনি গ্রেপ্তার তিন সেনা কর্মকর্তার হয়ে আইনি লড়াই করছেন। তবে আইনজীবীর উদ্দেশ্যে আসামীরা (আপনার ক্লায়েন্ট) লিটারেল পারসন বলে মন্তব্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
একপর্যায়ে কাঠগড়ায় থাকা ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী দাঁড়িয়ে যান।
একে একে যার যার অভিযোগ পড়ে শোনান বিচারক। তাদের অভিযোগ প্রায় একই। তাদের দায়িত্বপালনকালে জেআইসি সেলে গুম ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী, মাইকেল চাকমা। কিন্তু ভুক্তভোগীদের ছেড়ে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেননি এই তিন সেনা কর্মকর্তা।
প্রথমে অভিযোগের বিষয়ে সরওয়ারকে জিজ্ঞেস করা হয় বুঝেছেন কিনা। জবাবে হ্যাঁ সম্বোধন করে তিনি বলেন, মহামান্য আদালত, আমি নির্দোষ। সুবিচার প্রার্থনা করছি। তখন বিচারপতি শফিউল বলেন, ইনশাআল্লাহ, ন্যায়বিচারই হবে।
মাহবুবুর রহমানও নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার চান। তানভির মাজহার বলেন, আমি নির্দোষ মহামান্য আদালত। আমিও ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি।
পরে চার্জ গঠনের পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে একটি আবেদন করবেন বলে জানান এই তিন আসামীর আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু। এ সময় এর বিরোধিতা করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আগে অভিযোগ গঠনের আদেশ পাস ও তারিখ নির্ধারণ হবে। এরপর তারা (ডিফেন্স) আসবেন। অথচ এর আগেই ভবিষ্যতের আবেদন করা নিয়ে আইন পড়ছেন।
একপর্যায়ে পরবর্তী বিচারিক কার্যক্রমের জন্য দুই মাস সময় চান দুলুসহ অন্যান্য আইনজীবী। তখন সম্পর্কিত আইন পড়ে শোনানো হয়।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আইনে চার্জ গঠনের ন্যূনতম ২১ দিনের মধ্যে পরবর্তী কার্যক্রমের কথা বলা আছে। কিন্তু তারা (ডিফেন্স) বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। যেন কোনো ট্রায়াল না হয়। এজন্যই এত সময় চাইছেন। আগামী দুই বছর পেলেও তাদের কাজ হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) গঠনের পাশাপাশি প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১৯ জানুয়ারি ঠিক করেন ট্রাইব্যুনাল। ওই দিনই গুমের এ মামলায় আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হবে। এ মামলায় আসামীদের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২২ অক্টোবর থেকে গত বছরের ৬ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে গুমের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামীদের বিরুদ্ধে মোট ৫টি অভিযোগ রয়েছে।
প্রসিকিউটর শাইখ মাহদী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গুমের বিচার শুরু হতে যাচ্ছে। আগামী ১৯ জানুয়ারি সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন ও সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রম শুরু হবে।
প্রসিকিউটর মাহদী বলেন, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টার বা জেআইসিতে গুমের মামলায় চার্জ গঠনের আদেশের জন্য দিন ধার্য ছিল। পাঁচটি চার্জ গঠন করে আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এর প্রেক্ষিতে এ মামলার আনুষ্ঠানিক বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলো।
তিনি বলেন, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারটি আয়নাঘর নামে পরিচিত। এখানে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২৬ জনকে গুম করে রাখা হয়েছিল। তাদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছিল। এসবের ভিত্তিতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেনা কর্মকর্তাসহ ১৩ আসামীর বিরুদ্ধে এই চার্জটি গঠন করেন আদালত। আমরা প্রসিকিউশনের পক্ষে ৪০ জনেরও বেশি সাক্ষীর নাম জমা দিয়েছি।
অভিযোগ গঠনের আদেশের পর সাধারণত ২১ দিন সময় দেওয়া হয়। এবার সময়টা একটু বেশি এলো। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে এই প্রসিকিউটর বলেন, আসামীপক্ষ দুই মাস সময়ের জন্য আবেদন করেছিলেন। সার্বিক বিবেচনায় তাদের চার সপ্তাহের সময় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে গতকাল প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, শাইখ মাহদীসহ অন্যরা। গ্রেপ্তার তিন আসামীর পক্ষে আজিজুর রহমান দুলু ছাড়াও ব্যারিস্টার মাহিন রহমান ও মাসুদ সালাহউদ্দিন এবং পলাতক আসামীদের পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আইনজীবীরা ছিলেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় পলাতক ১০ আসামীর পাঁচজনই ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে। এর মধ্যে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আকবর হোসেন, মেজর জেনারেল (অব.) সাইফুল আবেদিন, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. সাইফুল আলম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরী ও মেজর জেনারেল (অব.) হামিদুল হক।
বাকিরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ তৌহিদুল উল ইসলাম, মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মখছুরুল হক। আসামীদের মধ্যে তিনজন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকীরা পলাতক।