আজ ৫ ডিসেম্বর শুক্রবার। ১৯৭১ সালের এই দিন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পথে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রযাত্রা আরও জোরদার হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং জাতিসংঘে এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।এই দিনে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল শক্র মুক্ত হয়।
১৯৭১ সালের এ দিন মুক্ত হয় উত্তরবঙ্গের পীরগঞ্জ, হাতিবান্ধা, পঞ্চগড়, বোদা, ফুলবাড়ী, বীরগঞ্জ ও নবাবগঞ্জ। আর জীবননগর, দর্শনা ও কোটচাঁদপুরে পাকিস্তানী বাহিনী মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলা এই দিনে শত্রু মুক্ত হয়। ৫ ডিসেম্বর যশোরের চৌগাছাতে ট্যাংক যুদ্ধের সূচনা হয়। সে যুদ্ধে ভারতের ট্যাংক রেজিমেন্ট যুদ্ধ করে। তাদের সঙ্গে অবস্থান নিয়েছিল ৮ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা এবং আরেকটি সেনাদল এগিয়ে যায় যশোর অ্যাক্সিসের দিকে। সে দিন যশোর বিমানবন্দরের ওপরে আর্টিলারি ও মর্টার শেলের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ হয়। কারণ সেখানে পাকিস্তানিদের শক্ত অবস্থান ছিল। তারাও যুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল।
৫ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট স্থলপথে এগিয়ে আসে। এদিন মিত্রবাহিনী বিভিন্ন সেক্টরের প্রধান প্রধান সড়কে অবরোধ সৃষ্টি করে ঢাকার সঙ্গে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, নাটোর, রংপুর, যশোর ও রাজশাহীর সড়কপথের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। জায়গায় জায়গায় অবস্থান নেয় তারা।
৫ ডিসেম্বর সিলেটের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আলফা কোম্পানি কানাইঘাট থেকে বিকাল ৫টায় এমসি কলেজ অভিমুখে যাত্রা করে পরদিন বিকেল ৫টায় কেওয়াছরা চা বাগানে অবস্থান নেয়। কিন্তু এদিন রাতে আলফা কোম্পানির পেট্রোল পার্টি হানাদারদের অ্যামবুশে পড়ে। একজন নিখোঁজ হয়। পরদিন সকালে পাকিস্তানের সেনাদের অবস্থান জানার জন্য বের হলেও বাধার মুখে পড়ে পিছু হটে পেট্রোল পার্টি। ফের সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায় তারা। এ সময় পাকিস্তানীসেনা বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। সন্ধ্যার পরে মুক্তিযোদ্ধারা এমসি কলেজের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
৫ ডিসেম্বর যশোরের নোয়াপাড়া থেকে লেফটেন্যান্ট এস এম খালেদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খাইরাই স্কুলে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালে তারা পালিয়ে খাইরাই শহরে প্রবেশ করে। এদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা যশোর শহরে অবস্থানরত পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ না চালিয়ে বাইরের গেরিলাদের একত্রিত হওয়ার আদেশ দেন।
৫ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়াতে মুক্তিবাহিনী ও ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানের সেনারা। পরে কিছু সেনা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। এদিন আখাউড়া দখলের পর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী সিলেটের করিমগঞ্জ দখল করে মুন্সীনগরের দিকে এগিয়ে যায়। এদিন মুন্সীনগরও দখল করে মুক্তিবাহিনী। তারপর মৌলভীবাজারের দিকে এগিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে যশোর-কুষ্টিয়া রেলওয়ে জংশন দখল করে রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে মুক্তিযোদ্ধারা।
৫ ডিসেম্বর যশোরের ঝিকরগাছায় মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্থানী সেনাদের পতন হলে ৩ দলে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যশোর আক্রমণ শুরু করেন। উত্তর পাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল যশোর-ঝিনাইদহ সড়কে আক্রমণ শুরু করে। আরেকটি দল ধান খেতের মধ্য দিয়ে চিতের বিল অতিক্রম করে। বেনাপোল-যশোর সড়ক দিয়ে আরেকটি দল এগিয়ে যায়। ৫ ডিসেম্বর ঝিনাইদহের উত্তর ও পশ্চিমে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায় ভারতীয় চতুর্থ ও নবম ডিভিশন। এক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর হামলায় পাকিস্তানী বাহিনী বিধ্বস্ত হয়ে যশোর সড়কের পাশে অবস্থান নেয়। ৫ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে উইং কমান্ডার এমকে বাশারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ধরলা নদী অতিক্রম করে কুড়িগ্রাম দখল করে। এ সময় হানাদার বাহিনী কুড়িগ্রাম থেকে পালিয়ে লালমনিরহাটের দিকে চলে যায়।
মূলত এ দিন থেকে বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মূল লড়াই শুরু হয় দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল বাংলাদেশের পক্ষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আর বাংলাদেশ সম্পর্কিত তৃতীয় প্রস্তাবটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করে বেলজিয়াম, ইতালি ও জাপান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনের এই উত্তপ্ত অবস্থার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল যেন হারিয়ে না যায়, সে জন্য মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ দেন।
৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রশ্নে যুদ্ধ বিরতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ভারত ও পাকিস্তানের সেনা অপসারণ সংক্রান্ত প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এই প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রভাবশালী সদস্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো দেয়। ভেটো দেয় পোল্যান্ডও। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয় ১১টি দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে ভেটো দেয়ার কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি ইয়াকুব মালিক বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।