বাংলাদেশ জামায়াতে আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, স্বৈরশাসকের আমলে আমাদের নেতৃবৃন্দকে কাউকে ফাঁসিতে পাঠিয়ে খুন করা হয়েছে, কাউকে জেলে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে (এটিএম আজহারুল ইসলাম) বাঁচিয়ে রেখেছেন এই বান্দার মাধ্যমে আল্লাহ সত্যকে জাতির সামনে পরিষ্কার করবেন বলে। তার খালাস এবং মুক্তির মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয়েছে আমাদের কলিজার টুকরা সমস্ত নেতৃবৃন্দকে ঠান্ডা মাথায় বিশেষ উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর মগবাজারের আল ফালাহ মিলনায়তনে সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির পর মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা আমাদের প্রিয় ভাইয়ের নসিহা শুনেছি। তার কথা প্রাণভরে আরও শুনবো। আমরা আমাদের ভাইয়ের জন্য দোয়া করি। শারীরিক ও মানসিকভাবে অবশ্যই তার উপরে প্রচ- চাপ গেছে; এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্য ধারণ করার যে তাওফীক তাকে দান করেছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করি। আল্লাহ তায়ালা ধৈর্য ধারণ করার জাযাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে দান করুন।
আপনারা জানেন, জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তার পরিবার অনেকটাই ছিন্নভিন্ন। ছোট্ট মেয়েটা ছাড়া এখন দেশে আর কেউ নাই। একমাত্র ছেলে দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন অনেকের মত। এর মাঝে তিনি জেলে থাকা অবস্থায় ভাবীও (আজহার সাহেবের স্ত্রী) দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া যে, অন্তত তিনি তার স্ত্রীর জানাযায় হাজির হয়ে নিজে বিদায় দিতে পেরেছেন। আল্লাহ তায়ালা এইটুকু সুযোগ তাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনটা তাদের দু’জনের পরস্পরের উপর যে হক ছিলো; সঙ্গত কারণে আল্লাহর জন্য সে হক আদায় করা সম্ভব হয়নি। আল্লাহ যেন তাদেরকে আদালতে আখেরাতে একসাথে হাশর নছিব করেন। জান্নাতে আল্লাহ যেন আবার তাদেরকে একসাথে চমৎকারভাবে একত্রিত করে দেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যবর্গসহ।
আলহামদুলিল্লাহ আমরা অনেক জায়গায় যেতাম অনেকে জিজ্ঞাসা করতেন আজহার ভাইয়ের কী অবস্থা। উনার মুক্তি কবে হবে? কোনো ষড়যন্ত্র হবে কিনা? অ- নে-ক প্রশ্ন ছিল। আমরা বলতাম যে, সবকিছু আল্লাহ তায়ালার ফয়সালার উপর ছেড়ে দিয়েছি। তবে একটা জিনিস আমরা বিশ^াস করি যে সমস্ত নেতৃবৃন্দ এক এক করে চলে গেলেন; কাউকে ফাঁসিতে পাঠিয়ে খুন করা হলো, কাউকে জেলে রেখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হলো। আল্লাহ যেহেতু তাঁর এই বান্দাকে জীবিত রেখেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই এই বান্দার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা সত্যকে পৃথিবীবাসীর সামনে পরিষ্কার করবেন। আল্লাহ তায়ালার লাখো শুকরিয়া যে আল্লাহ সেই কাজটিই করেছেন। এর মাধ্যমে এটিই প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের কলিজার টুকরা সমস্ত নেতৃবৃন্দকে ঠান্ডা মাথায় বিশেষ উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্যটা আর কিছু নয়। সেটা ছিল তারা আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিলেন। আল্লাহ তায়ালাকে পরম পরাক্রমশালী এবং প্রশংসিত হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। সমস্ত পরাক্রমের মালিকও তিনি সঙ্গত কারণেই প্রশংসা পাওয়ার মালিকও তিনি। এটাই তাদের অপরাধ।
তিনি বলেন, সম্মানিত নেতৃবৃন্দ চোখের সামনে তারা বুঝতে পারছিলেন যে, তিলে তিলে তাদেরকে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে এতটাই তাওয়াক্কুলের শক্তি, এতটাই সবর এখতিয়ার করার তাওফিক দান করেছিলেন যে, তারা কেউ এক সেকেন্ডের জন্যও মোটেই বিচলিত হননি। যারা দুনিয়া থেকে আগে চলে গেছেন আমরা বিশ^াস করি আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসার জান্নাতে তারা আছেন। কিন্তু ফাঁসির এই দ- মাথার উপরে নিয়ে তিলে তিলে অপেক্ষা করা, বেঁচে থাকা; আল্লাহ তায়ালা যদি তাদের মনকে শক্ত না রাখেন, ঈমানের মজবুতি যদি দান না করেন, বান্দা যদি সবকিছু একেবারে আল্লাহর উপর ছেড়ে না দেন; তাহলে কোন মানুষের পক্ষে এটা হজম করা সম্ভব নয়।
কোনো এক বিশিষ্ট লোক বলেছিলেন, যাদের রায়ের আদেশ প্রথম শোনানো হয়, তখন তারা অস্বাভাবিক আচরণ করেন। অভিশাপ দেন, কেউ গালি-গালাজ করেন। বাস্তবায়নের সময় তারা অনেকেই স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এজন্য আগে থেকে তাদেরকে মেডিকেল চেক আপ-এর মধ্যে সার্বক্ষণিক সতেজ রাখা হয়। তবে শুধু জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ ব্যতিক্রম ছিলেন। তাদেরকে রায় শুনানোর পর থেকে রায় বাস্তবায়নের আগ পর্যন্ত এক মিনিটের জন্যও তাদের চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। আল্লাহু আকবার। পরিবর্তন হয়নি এই কারণে যে, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দা হিসেবে ঐ আওয়াজ শুনে শুনে দুনিয়া থেকে যেতে চান। ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার রবের দিকে ফিরে আস সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে।’ আমরা বিশ্বাস করি তারা এই আওয়াজ শুনে শুনে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন এবং আমরা ধারণা করছি আল্লাহর প্রতিশ্রুত সেই জান্নাতে হয়ত তারা জায়গা পেয়ে গেছেন। আজকে এতটুকু পর্যন্ত আমরা শেষ করতে চাই। আরও কিছু প্রোগ্রাম আছে। তার (জনাব আজহার) শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম প্রয়োজন। কয়টা দিন তার সাক্ষাতের এবং তার কাছে কিছু জানা শোনা থেকে সবর করলে ভাল হয়। এরপর তিনি আমরা আশা করি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আমাদের সাথে দেখা হবে, মোলাকাত হবে এবং আমরা একসাথে কাজ করব ইনশাআল্লাহ।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই ঢাকায় যে এলাকায় তিনি দীর্ঘদিন সংগঠন পরিচালনা করেছেন, কাজ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন আমাদের এই প্রিয় ভাইটিকে নিয়ে বড় পরিসরে প্রোগ্রাম করার মাধ্যমে ঢাকাবাসীর কাছে দোয়া চাইব। তিনি তার জন্মস্থানেও যাবেন ইনশাআল্লাহ যে সময় তিনি কমফোর্ট ফিল করবেন। সারা দেশের ন্যায় তার নিজ এলাকাতেও সংগঠন বড় প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করবে ইনশাআল্লাহ। আমরা ইচ্ছা করেই তার নিজ এলাকাকে প্রোগ্রাম করা থেকে বাদ রেখেছিলাম। আমরা পূর্বেই বলেছিলাম আল্লাহ চাহে তো আমাদের প্রিয় ভাইসহ রংপুরবাসীকে নিয়ে বড় পরিসরে প্রোগ্রাম করব। আল্লাহ উনাকে সাথে নিয়ে সেই প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করার তাওফীক দান করেন। আপনারা দোয়া করবেন, আমাদের এই আশাকে আল্লাহ তাঁর বারাকাহ দিয়ে রহমত দিয়ে সাহায্য করেন। আমরা যেন আমাদের ভাইকে নিয়ে আল্লাহর দাওয়াত উত্তম পন্থায় মানুষকে সত্যের দিকে, কল্যাণের দিকে, দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির দিকে প্রাণভরে ডাকতে পারি। আল্লাহ যেন আমাদের সেই তাওফীক দান করেন। আপনারা শাহবাগ থেকে আবার এখানে অনেক কষ্ট করে এসেছেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উত্তম জাযাহ দান করুন এবং আগামীর হক্ক কায়েমের লড়াইয়ের জন্য আল্লাহ আমাদের বুক শক্ত করে দিন, প্রশস্ত করে দিন। আমাদের পা মজবুত করে দিন। আমাদের ভাইসহ সবাইকে হায়াতে তায়্যেবা দান করুন।
এর আগে আমীরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান শাহবাগে শোকরানা অনুষ্ঠানে এটিএম আজহারকে ‘মজলুম নেতা’ উল্লেখ করে তিনি যেন দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে পারেন, সে জন্য সবার দোয়া কামনা করেন। তিনি আরও বলেন, আমরা আগেই বলেছি এটা কোনো সভা নয়। জাস্ট মজলুম ভাইয়ের, মজলুম নেতার প্রাথমিক অভিব্যক্তি প্রকাশের একটা আয়োজন। প্রচন্ড গরমে এখানে আপনারা হাজির হয়েছেন। মঞ্চে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ আছেন, আমাদের বন্ধু সংগঠনসমূহের সম্মানিত নেতৃবৃন্দ আছেন, ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আছেন, শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আছেন এবং আপনারা আমরা সবাই আছি। তিনি আরও বলেন, আমাদের সম্মানিত এই ভাইয়ের বক্তব্য অচিরেই আরও বড় পরিসরে শুনব ইনশাল্লাহ। এই ঢাকাতেই শুনব ইনশাআল্লাহ। এজন্য আমি আজকে আমার বক্তব্য দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। আমি শুধু আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করি যে মানুষটাকে সুদীর্ঘ ১৪টি বছর ঘাড়ের উপর মৃত্যুদ-ের আদেশ দিয়ে জুলুম করা হয়েছে। আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। মহান রব তাকে আমাদের বুকে ফিরিয়ে দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামীন। আমাদের এই ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন সবাই। আল্লাহ যেন তাকে নেক হায়াত দারাজ করেন, তিনি যেন সুস্থ থাকেন এবং জাতির প্রয়োজনে তিনি যেন তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে পারেন।
আমীরে জামায়াত বলেন, কিছুক্ষণ আগে এখানে বলা হয়েছে আমার নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে, আমি তা মোটেই মনে করি না। আমি মনে করি এ দেশের ১৮ কোটি মজলুম মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জালিম সরকারের পতন হয়েছে। আমরা এর মূল ক্রেডিট আল্লাহ তায়ালাকে দেই। আর জমিনের এই ক্রেডিট এ দেশের জনগণকে দেয়ার পক্ষে। আমরা এক থাকব। জাতির প্রয়োজনে একপথে হাঁটবো এবং জাতির প্রয়োজনে সমস্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।
সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম-এর সঞ্চালনায় এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমীর সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, এড. মোয়াযযেম হোসাইন হেলাল, এড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি এড. মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য জনাব আবদুর রব, অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন ও জনাব মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমীর জনাব নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর জনাব মোঃ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও লইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি এড. জসিমউদ্দীন সরকার, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মুফতি সুলতান মহীউদ্দিন ও মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম, জাগপার সহসভাপতি ও মুখপাত্র ইঞ্জিনিয়ার রাশেদ প্রধান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান এসএম ইউসুফ, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. রেজাউল করিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শামিউল হক ফারুকি ও মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম, শহীদ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর পুত্র মাসুদ সাঈদী, শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর পুত্র ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমেন, শহীদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পুত্র আলী আহমাদ মাবরুর, জনাব এটিএম আজহারুল ইসলামের পুত্র তাসনিম আজহার সুমন, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার পুত্র হাসান জামিল এবং জনাব এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার আইনজীবীরা।