এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার নিরাপত্তার অয়োজন থাকছে তিন স্তরে। অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার একটু ভিন্ন কৌশলে এই নিরাপত্তা জোরদার করবে পুলিশ। নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন সমুহের কার্যক্রমের প্রতি থাকবে বিশেষ নজরদারী। তারা কোন ধরনের অপকর্ম-অঘটন ঘটাতে যেন না পারে, সেজন্য গোয়েন্দাদের চোখ যুগলও থাকবে অপলক। সব মিলিয়ে পূজার আগে ও পরের দিনগুলো যাতে কোন কারনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিষাদের না হয়, সেজন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে মাঠ পুলিশকে ৩৫ দফা নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। ওই নির্দেশনায় প্রাক পূজা, পূজা চলাকালীন, প্রতিমা বিসর্জন এবং প্রতিমা বিসর্জন পরবর্তী এই তিন ধাপে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজাতে বলা হয়েছে পুলিশের সকল ইউনিটকে। কোন ধাপেই নিরাপত্তা পরিকল্পনায় যাতে কোন ধরনের ফাঁক না থাকে তা পুলিশ সদর দফতর থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদারকি করা হচ্ছে। এজন্য পুলিশ সদর দফতরের অপারেশন কন্ট্রোল অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের অধীনে একটি জয়েন্ট কো অর্ডিনেশন সেল খোলা হয়েছে। যেটার কার্যক্রম আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হবে। চলবে ৪ অক্টোবর পর্যন্ত। এছাড়া দেশের সকল জেলা ও মহানগর পুলিশে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন ধরনের অপতথ্য বা গুজব ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে এজন্য পুলিশের সব ইউনিটকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাঠ পুলিশকে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর রোববার ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হতে যাচ্ছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। উৎসবের এই আনন্দ নির্বিঘœ এবং নিরাপদ করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সর্বোচ্চ প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
যোগাযোগ করা হলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন দৈনিক সংগ্রামকে জানান, দুর্গাপূজায় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মাঠ পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপতথ্য ছড়িয়ে কেউ যাতে অনাকাক্সিক্ষত কোন পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে এজন্য পুলিশের সকল ইউনিট সজাগ রয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৪ ঘন্টায় দুর্গাপূজা ঘিরে বেশ কয়েকটি অপতথ্য ছড়ানো হয়েছিল। আমরা আবার সেগুলোর ফ্যাক্টচেকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোকে ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এ বছর সারাদেশে ৩১ হাজার ৫৭৬টি পূজা মন্ডপে দুর্গা পূজা হবে। এর মধ্যে ৭ হাজার ৫৪টি পূজা মন্ডপকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ, ১০ হাজার ৯৭২টি গুরুত্বপূর্ণ এবং ১৩ হাজার ৫৫০টি পূজা মন্ডপকে সাধারণ হিসেবে ধরা হয়েছে। অধিক গুরুত্বপূর্ণ ৭ হাজার ৫৪টি পূজা মন্ডপে বিশেষ নিরাপত্তা দেবে পুলিশ। গত বছর (২০২৪ সাল) সারাদেশে ৩২ হাজার ৬৬৬টি, ২০২৩ সালে ৩২ হাজার ৪০৭টি, ২০২২ সালে ৩২ হাজার ১৬৮টি, ২০২১ সালে ৩১ হাজার ৫০৭টি, ২০২০ সালে ৩০ হাজার ৭১০টি এবং ২০১৯ সালে ৩১ হাজার ৯১টি পূজা মন্ডপে দুর্গাপূজা হয়েছিল। এ বছর বিজয়া দশমীর দিন ২৬ হাজার ৪৩৫টি পূজা মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হবে। পরবর্তী দিনে ১ হাজার ৩১১টি পূজা মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হবে এবং ৩ হাজার ৮৩০টি মন্ডপের প্রতিমা বিসর্জন হবে না।
প্রাক পূজার নিরাপত্তায় ১১ দফা নির্দেশনা : পূজা শুরুর পূর্বেই পূজা মন্ডপের স্থান, ও কমিটি নিয়ে বিরোধ থাকলে তা নিরসনকল্পে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা; শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে মন্দির, পূজা মন্ডপ, নির্মাণাধীন প্রতিমার নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা; প্রতিটি থানার ওসিকে প্রতিটি পূজা মন্ডপ পরিদর্শন এবং পূজা আয়োজক কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে। পূজা মন্ডপের নিরাপত্তা তদারকি ও পরিদর্শনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যকে প্রতিবার পূজা মন্ডপ পরিদর্শনকালে সংরক্ষিত রেজিষ্টারে তারিখ ও সময় উল্লেখ পূর্বক মন্তব্য লিখতে বলা হয়েছে। পূজা উদযাপন কমিটি ও সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে মত বিনিময় সভা করে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ ও প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর সংরক্ষণ করা; আযান ও নামাজের সময় মসজিদ পার্শ্ববর্তী পূজা মন্ডপগুলোয় পূজা চলাকালে এবং বিসর্জনকালে শব্দযন্ত্রের ব্যবহার সীমিত রাখা এবং উচ্চস্মরে শব্দযন্ত্র ব্যবহার না করার জন্য সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করতে মাঠ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নির্মাণাধীন প্রতিমা ও প্রতিমা নির্মাণ স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং নির্মাণস্থলে আইপি ক্যামেরা এবং সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও মনিটর করা; প্রতিমা নির্মাণকালীন, প্রতিমা পরিবহনের নিরাপত্তায় আয়োজক কমিটি কর্তৃক ভেটিংডপূর্বক স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা। বিশেষ করে রাতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা; আয়োজক কমিটি কর্তৃক স্বেচ্ছাসেবকদের ছবিযুক্ত বড় পরিচয়পত্র ও স্বেচ্ছাসেবক লেখা আমর্ড ব্যান্ড প্রদান নিশ্চিত করা; পূজা মন্ডপের সার্বক্ষণিক সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত নিরাপত্তা সদস্যদের মন্ডপের নিকটবর্তী স্থানে আবাসনের ব্যবস্থা করা; নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রম মনিটর করা এবং জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের কার্যক্রমের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষায় বিভিন্ন ধর্মের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে বিট পুলিশ কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা এবং এবং নিয়মিত পরিদর্শন করতেও মাঠ পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পূজাচলাকালীন ১৬ নির্দেশনা : পূজা চলাকালীন ১৬ দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে মাঠ পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ পূজা মন্ডপসমৃহে বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে হ্যান্ডহেল্ড মেটাল ডিটেক্টর ও আর্চওয়ে স্থাপন করা; ভিআইপি, ভিভিআইপি ও বিদেশি অতিথিদের পরিদর্শনকালীন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; পূজা উদযাপন কমিটি কর্তৃক পূজা মন্ডপে নারী ও পুরুষদের জন্য পৃথক প্রবেশ ও প্রস্থান পথের ব্যবস্থা করা; আগত দর্শনার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক কর্তৃক দেহ তল্লাশি করা (নারীদের ক্ষেত্রে নারী স্বেচ্ছাসেবক দ্বারা), কোন দুস্কৃতিকারী পূজা মন্ডপ এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃস্টি করলে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তারপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা; পূজা মন্ডপ এলাকায় প্যাট্রোল ডিউটি বৃদ্ধি করা, ঝুঁকি গুরুত্ব বিবেচনায় স্ট্যাটিক ফোর্স নিয়োজিত করা, প্রত্যেক মন্ডপে স্থানীয় প্রশাসন, থানা, পুলিশ ফাঁড়ি এবং ফায়ার সার্ভিসের টেলিফোন নম্বর দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে আয়োজকদের অনুরোধ করতে বলা হয়েছে।
প্রতিমা বিসর্জন ও বিসর্জন পরবর্তী ৮ নির্দেশনা : প্রতিমা বিসর্জনের স্থানসমৃহের তালিকা সংগ্রহ ও প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ; প্রতিমা নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ না করে নির্ধারিত রুটে বিসর্জন স্থানে পৌছানো নিশ্চিত করা এবং নিরাপত্তাজনিত কারণ ব্যতীত প্রতিমা পরিবহন রুট পরিবর্তন না করা; স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে বিসর্জন কার্যক্রম সমন্বয় করা; অস্থায়ী প্যান্ডেলে স্থাপিত প্রতিমাসমৃহ বিসর্জনের দিনেই বিসর্জন সম্পন্ন করার জন্য আয়োজকদের অনুরোধ করা; বিসর্জনকালে সংশ্লিষ্ট সড়ক ও ঘাটের পার্শ্ববর্তী এলাকার দোকান-পাট বন্ধ রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আইনশৃংখলাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন : এবার প্রতিটি পূজাম-পের নিরাপত্তায় ৭ জন স্বেচ্ছাসেবী, ৮ জন আনসার সদস্য ছাড়াও পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা থাকবেন। এবারের পূজায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবী রাখা হচ্ছে। প্রতিটি পূজাম-পে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকেও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে গতকাল ২৪ সেপ্টেম্বর বুধবার থেকে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। বিভিন্ন বাহিনী এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার শুরু করেছে।
এবারও সর্বাধিক সদস্য মোতায়েন করছে আনসার ও ভিডিপি। প্রায় দুই লাখ আনসার সদস্য দেশজুড়ে পূজাম-পগুলোতে দায়িত্ব পালন করবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ম-পগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছেÍ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ। প্রতিটি ম-পে আনসারের টহল টিম দায়িত্ব পালন করবে, আর ভিডিপি থাকবে সার্বক্ষণিকভাবে।